Headlines
Loading...
নাস্তিকবাদীদের ঈশ্বরের অনস্তিত্ব সম্পর্কে প্রধান যুক্তি।

নাস্তিকবাদীদের ঈশ্বরের অনস্তিত্ব সম্পর্কে প্রধান যুক্তি।

নাস্তিকবাদীরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন বা সরাসরি তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তাদের যুক্তিগুলো সাধারণত যুক্তিবাদ (Rationalism), বিজ্ঞান (Science), এবং অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism) থেকে আসে। আমি তাদের এই প্রয়াসকে সম্মান করি। কারণ তারা আর যাই হোক, ধর্মের নামে অন্তত অধর্ম করেন না। ঈশ্বর যদি সকলের কর্তা হয়ে থাকেন। তবে নাস্তিকগণ তারই সৃষ্টি। 

গুরুর কৃপায় আমি এটা জানতে পেরেছি যে, এই বিরোধ আপত্তি একটা খেলা বা লীলা মাত্র। মৃত্যুর পর সব শান্ত।ঈশ্বর মন দিয়েছেন, বুদ্ধি বা জ্ঞান দিয়েছেন। তাই সেগুলোর উপর ভিত্তি করে আমার আপত্তি হলো এই যে, কাল ও পরিস্থিতি নির্মিত পন্থ বা মতাদর্শ কে ধর্ম বলে ধর্মের আসল অর্থকে খর্ব করা হয়। 




১. বৈজ্ঞানিক যুক্তি (Scientific Arguments)

(ক) ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই

  • কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই।
  • কার্ল সাগান বলেছিলেন, "Extraordinary claims require extraordinary evidence" (অসাধারণ দাবির জন্য অসাধারণ প্রমাণ দরকার)।
  • এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানের কোনো গবেষণায় ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

"Extraordinary claims require extraordinary evidence"—এই নীতিটি জনপ্রিয়ভাবে কার্ল সাগানের বলে পরিচিত হলেও এটি আসলে দার্শনিক ডেভিড হিউমের চিন্তাধারা থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ হলো, যদি কেউ এমন একটি দাবি করে যা স্বাভাবিক বা প্রচলিত জ্ঞানের বিপরীত, তবে সেটির পক্ষে তেমনই শক্তিশালী ও প্রমাণযোগ্য যুক্তি থাকা প্রয়োজন। 

সাধারণ দাবি সাধারণ প্রমাণেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে, কিন্তু অতিপ্রাকৃত বা বৈজ্ঞানিকভাবে অস্বাভাবিক কিছু দাবির ক্ষেত্রে কেবল বিশ্বাস বা অনুমানের ভিত্তিতে গ্রহণ করা যুক্তিসঙ্গত নয়। উদাহরণস্বরূপ, 

কেউ যদি বলে যে তারা প্রতিদিন সূর্যোদয় দেখে, এটি একটি স্বাভাবিক দাবি এবং এটি অতিরিক্ত প্রমাণের প্রয়োজন হয় না, কারণ এটি আমাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে। কিন্তু যদি কেউ বলে যে তারা ভিনগ্রহের প্রাণীর সঙ্গে দেখা করেছে বা অলৌকিক ক্ষমতা রাখে, তবে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা বিশ্বাস যথেষ্ট নয়—এর জন্য পর্যবেক্ষণযোগ্য, পুনরাবৃত্তিযোগ্য এবং বৈজ্ঞানিক প্রমাণ প্রয়োজন। কারণ, অসাধারণ দাবির পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ ছাড়া তা গ্রহণ করা হলে প্রতিটি অবাস্তব বা ভিত্তিহীন দাবি একইভাবে সত্য বলে বিবেচিত হতে পারে, যা জ্ঞানের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করবে।

যদি কেউ দাবি করে যে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ অত্যন্ত অসাধারণ হতে হবে, তবে সেই প্রমাণ উপলব্ধি বা গ্রহণ করার জন্য ব্যক্তির নিজেকেও অসাধারণ বা উচ্চ ক্ষমতা অর্জন করতে হবে না কি? সাধারণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে কি সবকিছু প্রমাণ করা সম্ভব?  বিশেষ করে যদি বিষয়টি চেতনা, আধ্যাত্মিকতা বা আন্তরিক ধারণার সাথে সম্পর্কিত হয় ? 

ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে হলে শুধুমাত্র বাহ্যিক প্রমাণের ওপর নির্ভর না করে গভীর মনন, আত্ম বিশ্লেষণ, এবং আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে চেতনার উচ্চতর স্তরে পৌঁছাতে হবে। পতঞ্জলির যোগ দর্শনে আমরা কার্ল সেগেনের এই এক্সট্রা অর্ডিনারি এভিডেন্সের যুক্তির খন্ডন দেখতে পাই। যেখানে পতঞ্জলি খুব স্পষ্ট ভাবেই বলেছেন— "যোগ হলো চিত্ত ও বৃত্তির নিরোধ।"  

"निर्विचार वैशारद्येऽध्यात्मप्रसादः" (Yoga Sutra 1.47)

(Nirvichara Vaishāradye Adhyātma-Prasādah)

যা বাস্তবে নেই, কেউ যদি সেটা দর্শন করে। অর্থাৎ হ্যালুসিনেশন হয়। সেটাও স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে। ভ্রমের সংজ্ঞা (যোগসূত্র 1.8)

"विपर्ययो मिथ्याज्ञानमतद्रूपप्रतिष्ठम्॥"

(Viparyayo Mithyā-jñānam Atad-rūpa-pratiṣṭham॥)

অর্থ: ভ্রম হল মিথ্যা জ্ঞান, যা প্রকৃত সত্যের সঙ্গে মেলে না। অর্থাৎ, আমরা যা দেখি বা বুঝি, তা প্রকৃত বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং মনের কল্পনার ফলে সৃষ্টি হয়।

অন্যভাবে বলা যেতে পারে, "যদি ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ এতটাই অসাধারণ হয় যে সাধারণ মানুষের পক্ষে তা উপলব্ধি করা কঠিন, তবে সেই অসাধারণ প্রমাণ বুঝতে হলে আমাদের চেতনাকেও অসাধারণ হতে হবে।"  যেমন:—

  • বিগ ব্যাং থিওরি ব্যাখ্যা করে মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে, এতে কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তির প্রয়োজন নেই। কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিগ ব্যাং-এর আগে কাজ করত কি না, তা নিশ্চিত নয়, কারণ আমাদের পর্যবেক্ষণ শুধু বিগ ব্যাং-এর পর থেকে পাওয়া সম্ভব। এটি একটি গবেষণার বিষয়, এবং ভবিষ্যতে বিজ্ঞান হয়তো আরও নির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারবে। তবে বর্তমান তথ্য অনুযায়ী, "কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিগ ব্যাং-এর আগে কাজ করেছে"—এটি নিশ্চিত নয়, তাই এটি একটি অনুমান মাত্র।

কিছু বিজ্ঞানী "সাইক্লিক ইউনিভার্স" (Cyclic Universe) বা "মাল্টিভার্স" (Multiverse) তত্ত্বের প্রস্তাব দেন, যেখানে বিগ ব্যাং-এর আগে অন্য কিছু ছিল। কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, "কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন" বিগ ব্যাং-এর কারণ হতে পারে, কিন্তু এটি শুধুমাত্র একটি অনুমান (Hypothesis), নিশ্চিত প্রমাণ নয়। "কোয়ান্টাম টানেলিং" নামক একটি প্রক্রিয়ায় একটি শূন্যস্থান (Vacuum) থেকেও মহাবিশ্ব সৃষ্টি হতে পারে, তবে এটি কেবল গাণিতিক মডেল, বাস্তব পর্যবেক্ষণ নয়। 

সত্যি বলতে, আমরা জানি না। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন বিগ ব্যাং-এর "আগে" কী ছিল তা খুঁজে বের করতে, কিন্তু আমাদের বিজ্ঞান মহলের বর্তমান তত্ত্বগুলো এক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।

  • ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব (Evolution by Natural Selection) জীবনের উৎপত্তি ও বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করে, যেখানে সৃষ্টিকর্তার ভূমিকা প্রয়োজন পড়ে না।

ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব অনুসারে, প্রাণীরা ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়ে জটিল জীব হিসেবে গড়ে উঠেছে। তবে, এই তত্ত্বের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, যা "Benefit of Doubt" দিয়ে বিচার করলে স্পষ্ট হয়। রামায়ণের মতো প্রাচীন শাস্ত্রগুলোকে একদমই কল্পনা বলে উড়িয়ে না দিয়ে, এগুলোর পেছনে বাস্তব কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকতে পারে বলে গবেষণা করা যেতে পারে। 

রামায়ণে বর্ণিত হনুমান ও বানর সেনার অস্তিত্ব বিবর্তন তত্ত্বের চ্যালেঞ্জ হতে পারে। বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী, হোমো সেপিয়েন্স একমাত্র উন্নত মানব প্রজাতি, তবে যদি হনুমান ও বানর সেনা বাস্তব ছিল, তাহলে এটি প্রমাণ করে যে আমাদের জানা বিবর্তন ধারার বাইরেও অন্য কোনো বিলুপ্ত মানবগোষ্ঠী ছিল, যাদের উপস্থিতি বিজ্ঞান এখনো শনাক্ত করতে পারেনি।


হনুমান সংস্কৃতে কথা বলতেন, হনুমান চল্লিশায় বলা হয়েছে, তিনি যজ্ঞ পবিত ধারণ করতেন। যা স্পষ্টতই একটি মানুষের বৈশিষ্ট্য। সাধারণ প্রাণীরা ভাষা ব্যবহার করতে পারে না, তাই হনুমান যদি শুধুমাত্র একটি বুদ্ধিমান প্রাইমেট হতেন, তবে তার সংস্কৃত জ্ঞান ও কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা ব্যাখ্যা করা কঠিন। এটি ইঙ্গিত করে যে, হয়তো একসময় এমন একটি উন্নত মানবগোষ্ঠী ছিল, যারা বর্তমান মানুষের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন শারীরিক গঠনের অধিকারী ছিল। 

চার দাঁতওয়ালা হাতির মতো কিছু প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর বিবরণ রামায়ণে রাবণের রাজ মহলের বাইরে পাহারা দিচ্ছে এমন উক্তি পাওয়া যায়, যা সত্যিকার বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে মিলেও গেছে। 

স চতুর্দন্তসম্যুক্তৈঃ পত্রিভিঃ পর্বতোপমৈঃ।
পরিক্লিষ্টৈশ্চ মত্তৈশ্চ নানাদেশ্যৈশ্চ হস্তিভিঃ।।

তাহলে, হনুমান ও তার জাতির মতো উন্নত ও বুদ্ধিমান একটি মানবগোষ্ঠী বাস্তবে ছিল কি না, সে প্রশ্নও খোলা রাখা উচিত। বিবর্তনবাদ এখনও অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি, বিশেষ করে ভাষার বিকাশ ও মানুষের আকস্মিক বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে এটি এখনো অসম্পূর্ণ । যদি হনুমান ও বানর সেনা বাস্তব হয়, তবে বিবর্তন তত্ত্ব পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন হতে পারে।

হনুমান, বালি, সুগ্রীব যদি বাস্তবে থেকে থাকেন, তবে তারা হয়তো কোনো বিলুপ্ত মানবগোষ্ঠী বা বিশেষ প্রজাতির প্রাইমেট হতে পারেন, যাদের সাথে প্রাচীন হোমো সেপিয়েন্সের যোগাযোগ ছিল।

(গ) চেতনা ও আত্মার কোনো অতিপ্রাকৃতিক ভিত্তি নেই

  • নিউরোসায়েন্স দেখিয়েছে যে চেতনা (Consciousness) মস্তিষ্কের কার্যকলাপের ফলাফল।

দার্শনিক ডেভিড হিউমের  extraordinary evidence কি এই ক্ষেত্রে কাজ করে না? মস্তিস্কের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ যদি চেতনা হয়। তবে ইলেকটিক ইমপালস জেনারেট করে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতে পারছে না কেন? কারণ, মৃত্যুর পর, মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেন এবং পুষ্টির অভাবে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, ফলে বৈদ্যুতিক ইমপালস বা অন্যান্য পদ্ধতির মাধ্যমে মৃত মস্তিষ্ককে পুনরায় সক্রিয় করা বর্তমানে অসম্ভব। 

চেতনা কি কেবল ইলেকট্রিক ইমপালস, নাকি তার চেয়েও কিছু বেশি?


যদি চেতনা শুধুই বৈদ্যুতিক সংকেত হয়, তাহলে কৃত্রিমভাবে ইলেকট্রিক ইমপালস দিয়ে মৃত মস্তিষ্ককে পুনরায় সচল করা সম্ভব হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হচ্ছে না।

অন্যদিকে, যদি চেতনা শুধুমাত্র ইলেকট্রিসিটি না হয়ে আরও জটিল জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফল হয়, তাহলে এটি কেবল ইলেকট্রিক ইমপালস দিয়ে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়।

এই দার্শনিক প্রশ্নের কোনো একক বৈজ্ঞানিক উত্তর নেই। কেউ কেউ বলেন, চেতনা শুধুই মস্তিষ্কের কার্যকলাপ, আবার অন্যরা মনে করেন, চেতনা একটি ভিন্ন বাস্তবতা বা অজানা উপাদান যা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা হয়নি।

আপনার মতামত কী? চেতনা কি শুধুই নিউরনের কার্যকলাপ, নাকি অন্য কিছু?

তবে, আপনি প্রশ্ন করতে পারেন:

প্রথমত. যদি আমাদের চেতনা ঈশ্বরের অংশ হয়, তাহলে মৃত্যু মানে কি ঈশ্বরের মধ্যে ফিরে যাওয়া?

হ্যা, আমরা ঈশ্বর ব্যতীত আর কিছুই না। বাইবেল বলছে, ঈশ্বর আমাদের তাঁর স্বরূপ আদমকে গঠন করেছে। যীশু খ্রীষ্ট নিজের সম্পর্কে একই বক্তব্য রেখেছেন— “যে আমাকে দেখেছে সে পিতাকে দেখেছে”। বেদান্ত তাঁরও হাজার হাজার বছর আগে বলেছে, "অহম ব্রহ্মাম্মি, একমেবদ্বিতীয়ম। 

দ্বিতীয় প্রশ্ন হতে পারে, ব্যক্তিগত চেতনা যদি বিশ্বচেতনার অংশ হয়, তাহলে স্মৃতি ও ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্যতা বজায় থাকে কীভাবে?

স্মৃতি ও ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য বলে আসলে কিছুই নেই। যা আমরা করছি বলে ভবি, সেগুলো ওই বিশ্ব চেতনার অংশ মাত্র। যেখানে কাল শূন্য থাকে সেখানে স্মৃতি লোপ পেয়ে যায়। কারণ ঘটনার ব্যবধান নেই। গাঢ় নিদ্রায় কোনো স্মৃতি থাকে না, কোনো স্বপ্ন থাকে না। যদি আমরা এক চেতনার বিভিন্ন প্রকাশ হই, তাহলে ব্যক্তিসত্তা ও স্মৃতি শুধুই কালের বিভ্রম। যখন ব্যক্তি এই স্বতন্ত্রতার বিভ্রম থেকে মুক্ত হয়, তখনই সে আত্মস্বরূপে অবস্থিত হয়। অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করে। যেখানে বোধ স্পষ্ট হয়ে , আমিই সেই ঈশ্বর জিনি এই এসবের কারণ তবে আমি কি মুক্ত হলাম না?  একটি উপমা দ্বারা বোঝানোর চেষ্টা করি — বৈদ্যুতিক বাল্বের অলোর উৎস যে আসলে বৈদ্যুতিক শক্তি সেটাই জানলেই তো বিদ্যুতের বিল জিরো করার উপায় পাওয়া যায়।

যতক্ষণ ব্যক্তি আলোর (অহংকার/মায়া) দিকে তাকিয়ে থাকে, ততক্ষণ সে তার উৎসকে (বিদ্যুৎ/ব্রহ্ম) দেখতে পায় না।

যেই মুহূর্তে সে উপলব্ধি করে যে আলো আসলে বিদ্যুৎ ছাড়া কিছু নয়, তখন সে ‘আলোকিত’ হয়। তখন আর তার আলাদা সত্তা রইল না, কারণ সে জানল, "আমি-ই সেটি" (अहं ब्रह्मास्मि)।

তাহলে, আর অতিরিক্ত প্রশ্নের প্রয়োজন নেই?

বেদান্তের দৃষ্টিকোণ থেকে, সত্য উপলব্ধির পর বাকি সকল জন্ম, জন্মান্তর, কর্ম, কর্মফল, ঈশ্বর, নরক স্বর্গ ইত্যাদি বিষয়ক প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। যতক্ষন কারণ, "জানি না, তাই প্রশ্ন করছি"—এটাই মায়ার চিহ্ন।

কিন্তু যারা এখনো বিভ্রমে আছে, তাদের জন্য এখনো বেদ, পূরণ, কোরআন, বাইবেলের প্রশ্ন ও তর্ক বিতর্ক গুলো প্রাসঙ্গিক। 


২. দর্শনগত যুক্তি (Philosophical Arguments)


নাস্তিক মহলে কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত যুক্তি আছে। যেমন The Paradox of Omnipotence" । যা ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান ধারণার একটি যৌক্তিক সমস্যা তুলে ধরে। তবে, বিভিন্ন দার্শনিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর উত্তর দেওয়া হয়েছে। সেই Paradox কি বলছে আগে জানি।।

  • ঈশ্বরকে বলা হয় "সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, সর্বদয়" (Omnipotent, Omniscient, Omnibenevolent)।
  • "সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কি এমন একটি পাথর তৈরি করতে পারেন যা তিনি নিজেই তুলতে পারবেন না?"
    • যদি পারেন, তবে তিনি সবকিছু তুলতে সক্ষম নন।
    • যদি না পারেন, তবে তিনি সর্বশক্তিমান নন।
    • তাই "সর্বশক্তিমান" ধারণাটি স্ববিরোধী।

অর্থাৎ, আপনাকে এমন একটি কাজ করতে বলা হয়েছে যেটি দুইদিক থেকেই আপনার হার নিশ্চিত করে।  আপনি যদি বিজয়ী হন তবে আপনি চিটিং করেছেন, আর যদি হেরে যান তাহলে আপনি ফালতু খেলোয়াড়। 

এটি একটি "কৌশলগত ফাঁদ" (Logical Trap) যেখানে যে দিকেই উত্তর দিই না কেন, ফলাফল একরকমই দেখানো হবে—পরাজয় বা অসঙ্গতি। এটি " "

আপনি কি এমন একটি গোল বৃত্ত তৈরি করতে পারেন যা চতুর্ভুজ?

— এমন প্রশ্ন যেগুলো "Logical Incoherence" এমন প্রশ্ন যেগুলো "যৌক্তিক অসামঞ্জস্যতা" করে, কারণ নিজের মধ্যেই অসংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ, প্রশ্নের ফাঁদে পড়ার দরকার নেই—প্রশ্নের স্ববিরোধিতা প্রকাশ করাই যথেষ্ট

 মন্দের সমস্যা (Problem of Evil & Suffering)

  • যদি ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ও সর্বদয় হন, তবে পৃথিবীতে এত দুঃখ, দুর্ভোগ, ও মন্দ (Evil) কেন আছে?
  • ঈশ্বর যদি এটি প্রতিরোধ করতে চান এবং পারেন, তবে এটি হওয়া উচিত নয়।
  • যদি প্রতিরোধ করতে না পারেন, তবে তিনি সর্বশক্তিমান নন।
  • যদি প্রতিরোধ করতে না চান, তবে তিনি সর্বদয় নন।

পৃথিবীতে দুঃখ ও দুর্ভোগ ও মন্দ (Evil) যেমন আছে। তেমনি সুখ, সমৃদ্ধি ও ভালো (Good) আছে। অর্থাৎ ঈশ্বরের কারণে জগতে শুধুই খারাপ নেই। এখন বিচার করে দেখতে হবে এই দুঃখ ও দুর্ভোগে কারা এবং কেন ভুগছে? 

একজন ভিখারী কথা ছেড়েই দিলাম। একজন লাখপতি দুঃখ ভোগ করে কি? উত্তর হলো হ্যা। কারণ সে কোটিপতি নয়। একজন কোটিপতি দুঃখ ভোগ করে কি? উত্তর হলো হ্যা, কারণ সে কোটিপতি হওয়ায় তার শত্রু বা তাকে নিয়ে ঈর্ষা করার লোকের অভাব নেই। তাই , কোটিপতি হয়েও তাঁর মানসিক সুখ নেই।  তাহলে সুখ বস্তুতে বা বাইরে নেই। সন্তুষ্টিতেই সুখ। ধর্ম বলছে তোমার যা দেওয়া হয়েছে সেটাতেই সুখী থাকো। অপরের ধন ও সম্পত্তির প্রতি লোভ বা মোহ করো না। 

"ধৃতি: ক্ষমা দম: অস্তেয়ং শৌচং ইন্দ্রিয়নিগ্রহ:।
ধীর্বিদ্যা সত্যমক্রোধো দশকং ধর্মলক্ষণম্॥"

অর্থাৎ— ধৈর্য, ক্ষমা, সংযম, চুরি না করা, পবিত্রতা, ইন্দ্রিয় দমন, জ্ঞান, সত্যবাদিতা ও ক্রোধ দমন—এই দশটি ধর্মের লক্ষণ।

দুর্ভোগের কারণ অনেক রকম হতে পারে। যেমন, শারীরিক, মানসিক, প্রাকৃতিক এবং আধ্যাত্মিক।

কর্ম ও কর্মফলের করনেও মানুষকে ত্রিতাপে দগ্ধ হতে হয়। হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে ত্রিতাপ হলো তিন ধরনের দুঃখ বা দুর্ভোগ, যা জীবের কষ্টের কারণ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। এই তিনটি তাপ হলো—

1. আধিদৈবিক তাপ (Ādhidaivika Tāpa) – 

প্রকৃতিগত বা দৈবিক দুর্ভোগ, যা প্রকৃতি বা অদৃশ্য শক্তির দ্বারা সৃষ্ট। উদাহরণ: ভূমিকম্প, ঝড়, বন্যা, বজ্রপাত, মহামারি ইত্যাদি।

2. আধিভৌতিক তাপ (Ādhibhautika Tāpa) – 

পার্থিব বা জাগতিক দুর্ভোগ, যা অন্য জীব বা বাইরের কারণে হয়। উদাহরণ: শত্রুর দ্বারা কষ্ট পাওয়া, যুদ্ধ, ডাকাতি, পশু বা কীটপতঙ্গের আক্রমণ, সামাজিক বৈষম্য ইত্যাদি।

3. আধ্যাত্মিক তাপ (Ādhyātmika Tāpa) – 

ব্যক্তিগত বা মানসিক দুর্ভোগ, যা নিজের মন, শরীর বা আত্মা থেকে উদ্ভূত হয়। উদাহরণ: রোগ-শোক, দুশ্চিন্তা, হতাশা, মানসিক কষ্ট, লোভ, ক্রোধ, মোহ ইত্যাদি।

বেদান্ত ও যোগ দর্শনে বলা হয়, মুক্তি (মোক্ষ) লাভের মাধ্যমে এই তিন প্রকার তাপ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ তিনি দুঃখ, দুর্ভোগ, ও মন্দ (Evil) থেকে মুক্তির উপায় ও পথ বলে দিয়েছেন। 

আমরা দেখছি—

  • দুঃখ ও দুর্ভোগ থাকলেই ঈশ্বর নেই, এটি ভুল ধারণা। সুখ ও দুঃখ আপেক্ষিক, প্রকৃত সুখ হলো সন্তুষ্টি ও প্রকৃত আধ্যাত্মিক জ্ঞান।
  • মানুষ তার কর্মফল অনুযায়ী ত্রিতাপের শিকার হয়, যা ঈশ্বরের সুবিচারের অংশ।
  • ঈশ্বর সুখ ও দুঃখ দিয়েছেন, তবে তাদের থেকে মুক্তির পথও দেখিয়েছেন—সেটাই হলো যোগ ও ভক্তি। 

অর্থাৎ ঈশ্বর যে সর্বশক্তিমান ও সর্বদয় এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

আরেকটি আরোপ হলো

(গ) ঈশ্বরের ধারণা মানুষের সৃষ্টি হতে পারে (God as a Human Construct)

  • নাস্তিকবাদীরা দাবি করেন যে "ঈশ্বরের ধারণা একটি সাংস্কৃতিক সৃষ্টি"
  • ইতিহাসে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্কৃতি তাদের নিজেদের ঈশ্বর সৃষ্টি করেছে।
  • ধর্মতাত্ত্বিক ইতিহাস অনুযায়ী, বহু দেবদেবীর ধারণা ক্রমান্বয়ে এক ঈশ্বরে রূপ নিয়েছে।

কথাটি সত্য হলেও সম্পূর্ণ সত্য নয়। সনাতন বৈদিক ধর্ম যা হিন্দু ধর্ম নামে নামকরণ হয়েছে তাহা কখনো সৃষ্টি হয়নি। এর কোন প্রণেতা নেই, নির্দিষ্ট কোন নির্দেশ বা আসমানী কিতাব নেই। এর ভিত্তি হল আত্ম বিশ্লেষণ এবং আধ্যাত্ম জ্ঞান। এখানে প্রতিটি মানুষ নিজেকে এবং অপরকে ঈশ্বরের সঙ্গে অভিন্ন মনে করে। ইতিহাস কতই বা পুরোনো?  

ঈশ্বর যদি শুধুই মানুষের মনগড়া ধারণা হতো, তাহলে সনাতন ধর্মের মতো একটি গভীর আত্ম-অনুসন্ধানমূলক পথ তৈরি হতো না। বরং এটি কেবল রীতিনীতি, উপাসনা বা ঐতিহ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি আত্ম-জ্ঞান ও বিশ্বচেতনার একত্ব, যা একে সাধারণ সাংস্কৃতিক বিশ্বাস থেকে আলাদা করে। 

সনাতন ধর্মের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি ঈশ্বরকে প্রশ্ন করার পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়। গীতা, উপনিষদ, ব্রাহ্মণ গ্রন্থ, এমনকি পুরাণেও দেখা যায় যে, প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ করা হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যই একে অন্যান্য একেশ্বরবাদী ও কঠোর ধর্মতন্ত্র থেকে আলাদা করে। সনাতন ধর্মে ঈশ্বরকে অন্ধভাবে মানার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, বরং যুক্তি ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাকে উপলব্ধি করতে বলা হয়েছে। গীতায় অর্জুন বহুবার কৃষ্ণকে প্রশ্ন করেছেন এবং যুক্তির মাধ্যমে উত্তর পেয়েছেন। কঠোপনিষদে নচিকেতা যমরাজকে মৃত্যুর পরের জীবনের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করেন এবং উত্তরে গভীর আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য এবং গার্গীর মধ্যকার তর্ক দর্শনের ক্ষেত্রে অসাধারণ একটি দৃষ্টান্ত।

এছাড়া, অন্যান্য ধর্ম যেখানে নাস্তিকতাকে দমন করেছে, সেখানে সনাতন ধর্ম নাস্তিকতাকে জায়গা দিয়েছে। রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডে, শ্রী রামের রাজসভায় ঋষি জাবালি আত্মা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। একইভাবে, একেশ্বরবাদ (দ্বৈতবাদ), অদ্বৈতবাদ (অহং ব্রহ্মাস্মি), বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ – সব দর্শনকেই জায়গা দেওয়া হয়েছে। তাই, একজন ব্যক্তি যদি বিশ্বাসী হন তবে তিনি ঈশ্বরকে নিজের মতো করে অনুভব করতে পারেন, আবার কেউ যদি নাস্তিক হন তবে তাঁর চিন্তাও গ্রহণযোগ্য।

সনাতন ধর্মের এই যুক্তিনির্ভর ও স্বাধীন চিন্তার প্রকৃতিই প্রমাণ করে যে, এটি শুধুমাত্র একটি সাংস্কৃতিক সৃষ্টি বা কল্পনাপ্রসূত ধর্ম নয়, বরং এটি প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধান। এখানে বিশ্বাস এবং যুক্তি পাশাপাশি চলতে পারে, আর তাই এটি মানব সভ্যতার প্রাচীনতম ও সর্বাধিক সহনশীল দর্শন।

আর কী বলবো? যদি আপনি বলেন ঈশ্বর পরীক্ষাযোগ্য নয়। সেই উত্তরও আমি দিতে পারি। তবে জেনে নিন নাস্তিক কেমন জবাব চায়:

  • বিজ্ঞান যা কিছু সত্য বলে ধরে নেয়, তার পরীক্ষা করা যায় (Testability) এবং পুনরাবৃত্তি করা যায় (Repeatability)।
  • ঈশ্বরের অস্তিত্ব পরীক্ষা করা সম্ভব নয়, কারণ এটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোনো বিষয় নয়।
  • এমন দাবিকে সত্য বলে ধরা কঠিন যার কোনো পরীক্ষাযোগ্যতা নেই।
কে বলেছে ঈশ্বরে অস্তিত্বের পরীক্ষা করা সম্ভব নয়? তন্ত্রের ভূত সাধনা, কর্ণ পিশাচ সাধনার মতো নিম্ন মার্গের সাধনা দ্বারা যে কেউ অন্তত ভূত পিশাচের সাক্ষাৎ দর্শন ও অনুভূতি করতে পারে। তবে প্রাণ সংশয় বা অঙ্গ হানির দায়িত্ব আমার নয়। উচ্চ মার্গের সাধনা অনেক সময় ও ধৈর্য সাধ্য। তাই পরীক্ষার জন্য ভূত পিশাচ সাধনার কথা বললাম। তন্ত্র সাধনায় গুরু ছাড়া এগুলোতে প্রবেশ করা বিপজ্জনক। কেউ যদি পরীক্ষা করতে চান, তবে তাকে তার ফলাফলও বহন করতে হবে।
  • দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russell) যুক্তি দেন:

যদি কেউ বলে "মঙ্গল গ্রহ ও পৃথিবীর মধ্যে একটি ছোট চায়ের পাত্র কক্ষপথে ঘুরছে", তবে এর সত্যতা প্রমাণের দায়িত্ব দাবিকারীর।

  • কেউ যদি বলে "ঈশ্বর আছেন", তবে তার সত্যতা প্রমাণের দায়িত্ব ঈশ্বরবাদীদের।
  • না পারলে, এটি মিথ্যা বলে ধরে নেওয়া উচিত। 

তিনি যুক্তির ভার (burden of proof) দাবিকারীর উপর চাপিয়ে দেন। অর্থাৎ, যদি কেউ কোনো অতিপ্রাকৃত বা অবিশ্বাস্য দাবি করেন, তবে তার সত্যতা প্রমাণের দায়িত্বও তাঁর। এটি আপাতদৃষ্টিতে যৌক্তিক মনে হলেও, বাস্তবে এটি যুক্তির অপব্যবহার (fallacy of misplaced burden of proof) , কারণ ঈশ্বরের ধারণা ও অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক সাধারণ পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বের মতো সহজ নয়। 

ঈশ্বর একটি দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ধারণা:

ঈশ্বর কেবল একটি বস্তুগত সত্তা নন, যিনি পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব। ঈশ্বরের ধারণা গভীরভাবে চেতনা, অস্তিত্ব, নৈতিকতা, ও বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত। তাই "চায়ের পাত্র" বা অন্য কোনো বস্তুগত উপমার মাধ্যমে ঈশ্বরের ধারণাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না।

"না পারলে মিথ্যা"—এই ধারণা ভুল:

কোনো কিছু প্রমাণ করা না গেলে, তা মিথ্যা প্রমাণ হয় না; বরং তা অজানা (unknown) থেকে যায়। বিজ্ঞানে অনেক বিষয় এমন রয়েছে যা একসময় প্রমাণ করা সম্ভব ছিল না, কিন্তু পরবর্তীতে তা সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। 

 নাস্তিক্যবাদীদেরও প্রমাণের দায় রয়েছে:

যদি কেউ দাবি করেন, "ঈশ্বর নেই", তবে তাঁরও এটি প্রমাণের দায় থাকে। কেননা, এটি একটি নেতিবাচক দাবি হলেও যুক্তিবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সমানভাবে প্রমাণসাপেক্ষ। কারণ আমরা বলছি ঈশ্বর আছে বলেই জগত আছে। আমরা জগতের অস্তিত্বকেই ঈশ্বরের প্রমাণ বলি।

অজ্ঞেয়বাদী (Agnostic) বলে, "আমি জানি না ঈশ্বর আছেন কি না।" এটি দাবি নয়, বরং একটি অজ্ঞতার স্বীকারোক্তি। কিন্তু নাস্তিক (Atheist) যদি বলে, "ঈশ্বর নেই," তাহলে এটি একটি জানার দাবি, এবং জানার দাবির জন্য প্রমাণ প্রয়োজন। প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র "আমি বিশ্বাস করি না" বললেই কিছু মিথ্যা হয়ে যায় না। 

ধরা যাক, এক জেলে বললো, "সমুদ্রের গভীরে একটি সোনার মাছ আছে।"

এখন, যদি তুমি বিশ্বাস করো না, তাহলে তুমি কেবল বলবে, "আমি নিশ্চিত নই, কারণ আমি নিজে দেখিনি।"

কিন্তু, যদি তুমি বলো, "না, এমন কোনো মাছ নেই," তাহলে তোমাকেও প্রমাণ করতে হবে যে তুমি পুরো সমুদ্র খুঁজে দেখেছো এবং কোথাও সেই মাছ নেই।

এ অবস্থায়, সোনার মাছের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যেমন কঠিন, এর অনুপস্থিতি প্রমাণ করা আরও কঠিন! 

যদি বলা হয়, "ঈশ্বর নেই", তাহলে আপনাকে পুরো বিশ্ব, সময়, ও বাস্তবতার সমস্ত দিক পরীক্ষা করতে হবে, যা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। প্র্যাকটিক্যালি সম্ভব নয়।

কেউ বলতে পারেন, ঈশ্বর নেই কারণ সে সারা দেয় না । এ অবস্থায় কেউ যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেন, তবে তাঁর কাছে ঈশ্বরের সাড়া দেওয়ার ধারণাই অবান্তর হয়ে যায়।

হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়,  কৃষ্ণ বলেছেন—

"যো যো যাং তানুং ভজতে তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং।"

(যেমন কেউ আমার উপাসনা করে, আমি তেমনই তার প্রতি প্রকাশিত হই।)

অর্থাৎ, আপনি নাস্তিক হলে তিনি অস্তিত্বহীন হয়েই আপনার সামনে আসবেন। ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমে ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশ করেন। কান্তের দার্শনিক তত্ত্ব অনুসারে, আমরা জগৎকে যেমন দেখি, সেটিই বাস্তবতা নয়; বরং আমাদের উপলব্ধি অনুযায়ী আমরা বাস্তবতাকে গড়ে তুলি।

অর্থাৎ, ঈশ্বরের অস্তিত্ব পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞান নয়, বরং অভিজ্ঞতাই মূল চাবিকাঠি। সাধনা করলে ঈশ্বরকেও অনুভব করা সম্ভব, যেমন অনেক সাধক করেছেন।কোনো ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক অনুভূতিই আপাতত সত্য বা মিথ্যা নয়, যতক্ষণ না তা যাচাই করা হয়।


    ৪. নৈতিক ও সামাজিক যুক্তি (Moral & Social Arguments)

    (ক) নৈতিকতা ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল নয় (Morality is Independent of God)

    • অনেকেই মনে করেন, "ধর্ম ছাড়া নৈতিকতা সম্ভব নয়", কিন্তু বাস্তবে নৈতিকতা মানুষের সামাজিক ও বিবর্তনীয় গুণ।
    • ইউথিফ্রো দিলেমা (Euthyphro Dilemma):
      • ঈশ্বর কি কিছু ভালো বলেই তা ভালো, নাকি তা ভালো বলে ঈশ্বর বলেছেন?
      • যদি ঈশ্বর স্বেচ্ছায় কিছু ভালো বা মন্দ নির্ধারণ করেন, তবে তা স্বেচ্ছাচারী।
      • যদি ঈশ্বরও নৈতিকতার নিয়ম মেনে চলেন, তবে নৈতিকতার উৎস ঈশ্বর নন।

    (খ) ধর্ম ও ঈশ্বরের নামে সহিংসতা ও বিভাজন

    • ইতিহাসে ধর্মের নামে বহু যুদ্ধ, সহিংসতা, এবং বৈষম্য ঘটেছে (যেমন: ক্রুসেড, ধর্মীয় মৌলবাদ, কুসংস্কার)।
    • অনেক নাস্তিক মনে করেন, ঈশ্বরের ধারণা সমাজকে বিভক্ত করে, মুক্ত চিন্তার বাধা সৃষ্টি করে।

    উপসংহার: ঈশ্বর নেই—এই দাবির ভিত্তি

    নাস্তিকদের যুক্তিগুলো মূলত এই বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে:
    বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই।
    ঈশ্বরের ধারণা অভ্যন্তরীণভাবে অসংগতিপূর্ণ হতে পারে।
    ধর্ম ও ঈশ্বরের ধারণা মানবসভ্যতার সৃষ্টি হতে পারে।
    নৈতিকতা ধর্মের উপর নির্ভরশীল নয়।
    ঈশ্বরের অস্তিত্বের কোনো পরীক্ষাযোগ্য প্রমাণ নেই।

    এখন প্রশ্ন হলো, তুমি এই যুক্তিগুলোর সাথে একমত নাকি ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে অন্য কোনো যুক্তি খুঁজছো?

    H. R. Sarkar is a dedicated blogger and entrepreneur with expertise in creating digital products and Blogger templates. Managing websites like TechaDigi.com and Hinduhum.net, they bring creativity and technical proficiency to their projects. Through their YouTube channel, Lost Eternal Science, H. R. Sarkar explores the fusion of Hindu spirituality and science, offering unique insights to their audience. With a passion for innovation, they strive to inspire and educate through their work.

    0 Comments:

    Smart Ads for Smart Businesses Ads by TDads