পশ্চিমা চিকিৎসা ইতিহাসের অন্ধকার দিক: অদ্ভুত ও অস্বস্তিকর চিকিৎসা পদ্ধতি
মানব সভ্যতার ইতিহাসে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অসাধারণ উন্নতি যেমন ঘটেছে, তেমনি এমন অনেক চিকিৎসা পদ্ধতিও প্রচলিত ছিল যা আজকের দৃষ্টিতে বিভীষিকাময় এবং অনৈতিক। ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যার অন্যতম অদ্ভুত দিক ছিল "মেডিসিনাল ক্যানিবালিজম", যেখানে মানুষের দেহাংশ ও রক্তকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের প্রচলন ছিল। অন্যদিকে, ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা সম্পূর্ণ আলাদা পথে এগিয়েছিল—যেখানে প্রাকৃতিক উপাদান, সমগ্র শরীরের সুস্থতা, এবং নৈতিক চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো।
ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে ভারতীয় শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অবমূল্যায়ন করেছিল। লর্ড ম্যাকলে'র শিক্ষা নীতি (১৮৩৫) ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে পাশ্চাত্য ভাবধারাকে চাপিয়ে দেয়।
ব্রিটিশরা ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রকে "কুসংস্কারাচ্ছন্ন" বলে প্রচার করে, যদিও তারা নিজেরাই পরবর্তীতে সেখান থেকে জ্ঞান গ্রহণ করে।
জার্মান ও ফরাসি গবেষকরা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করলেও ব্রিটিশরা ভারতীয়দের কাছ থেকে এই ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল।
পশ্চিমা চিকিৎসার আরও অদ্ভুত পদ্ধতিগুলো
উইলিসের চিকিৎসা ছিল ইউরোপীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক অঙ্গ। নিচে আরও কয়েকটি ভয়াবহ চিকিৎসা পদ্ধতির উল্লেখ করা হলো:
১. মমির গুঁড়ো (মুমিয়া)
ইউরোপীয় চিকিৎসকরা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য মিশরীয় মমির গুঁড়ো ব্যবহারের পরামর্শ দিতেন। ধারণা করা হতো, এতে রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা রয়েছে। এই চাহিদার কারণে কৃত্রিম মমির বাজারও গড়ে উঠেছিল।
২. মৃতদেহ থেকে তৈরি ওষুধ
তত্কালীন চিকিৎসকরা বিশ্বাস করতেন যে মানুষের রক্ত, চর্বি এবং হাড় বিভিন্ন রোগ সারাতে পারে। ফাঁসির আসামিদের তাজা রক্ত খাওয়ার প্রবণতাও ছিল, যা বিশেষত মৃগীরোগ (এপিলেপসি) সারানোর জন্য ব্যবহৃত হতো।
৩. তামাক ধোঁয়ার এনেমা
১৮শ শতাব্দীতে ধারণা করা হতো, তামাকের ধোঁয়া পায়ুপথে প্রবাহিত করলে ডুবে যাওয়া রোগীকে পুনরুজ্জীবিত করা যাবে। পরবর্তীতে এটি বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল প্রমাণিত হলে এই চিকিৎসা পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়।
৪. সিফিলিসের জন্য পারদ
অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে সিফিলিস রোগের চিকিৎসায় পারদ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এটি মারাত্মক বিষাক্ত হওয়ায় বহু রোগীর মৃত্যু ঘটত।
৫. মস্তিষ্কে গর্ত তৈরি (ট্রেপানেশন)
মৃগী বা মাথাব্যথার চিকিৎসার জন্য মাথার খুলি ফুটো করার পদ্ধতি ছিল একসময় জনপ্রিয়। এমনকি, হাজার হাজার বছর আগের খুলি পরীক্ষায় দেখা গেছে, অনেক রোগী এই পদ্ধতির পরও বেঁচে থাকতেন।
৬. রেডিয়ামযুক্ত জল
২০শ শতাব্দীতে রেডিয়াম মিশ্রিত পানি শক্তিবর্ধক হিসেবে বিক্রি করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে এটি ক্যানসার ও হাড় ক্ষয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
৭. ছাগলের অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপন
১৯২০ সালে জন আর. ব্রিঙ্কলি নামে এক ডাক্তার পুরুষদের যৌন দুর্বলতা নিরাময়ের জন্য ছাগলের অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপন করার দাবি করেন। যদিও এই পদ্ধতির কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না, এটি তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
একই সময়ের ভারতীয় চিকিৎসাব্যবস্থা
যেখানে ইউরোপীয় চিকিৎসা বিভীষিকাময় চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচলন ছিল। তখন ভারতে যোগ, আয়ুর্বেদ ও শল্য চিকিৎসা হতো। প্রধানত আয়ুর্বেদ ও সিদ্ধ চিকিৎসা সেই সময়ের ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যার মূল ভিত্তি ছিল।
১. আয়ুর্বেদ: জীবন বিজ্ঞানের শাস্ত্র
আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শরীর, মন ও আত্মার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ওপর জোর দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল:
পঞ্চকর্ম – পঞ্চকর্ম হল শরীর থেকে টক্সিন বা অশুদ্ধ১১ পদার্থ দূর করার জন্য আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার একটি প্রধান পদ্ধতি। এটি পাঁচটি প্রধান শোধনপ্রক্রিয়ার সমষ্টি, যা শরীরকে গভীরভাবে বিশুদ্ধ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
রসায়ন চিকিৎসা – দীর্ঘায়ু অর্জনের জন্য বিশেষ ভেষজ ব্যবহারের পদ্ধতি।
ধাতু ও খনিজ ব্যবহারে চিকিৎসা – সোনার ভস্ম, রুপা, এবং পারদ নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় নাড়ী সোধণের জন্য ব্যবহৃত হতো।
২. সিদ্ধ চিকিৎসা: সম্পূর্ণ দেহের সুস্থতার উপায়
সিদ্ধ চিকিৎসায় ভেষজ, খনিজ, এবং খাদ্যভিত্তিক নিরাময়ের ওপর জোর দেওয়া হতো। এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক:
কায়াকল্প চিকিৎসা – শরীরের পুনর্জীবন এবং বার্ধক্য রোধের জন্য ব্যবহৃত হতো।
ভেষজ চিকিৎসা – বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী রোগ নিরাময়ে শত শত উদ্ভিদের ব্যবহার।
যোগ ও ধ্যান – শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য অংশ।
৩. প্রাচীন ভারতের শল্যচিকিৎসা (সার্জারি)
ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা বিশ্বের প্রাচীনতম শল্যচিকিৎসার (সার্জারি) মধ্যে অন্যতম ছিল। শুশ্রুত (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০) তাঁর শুশ্রুত সংহিতা গ্রন্থে ১২০টি অস্ত্রোপচার যন্ত্র ও ৩০০টি অস্ত্রোপচার পদ্ধতি বর্ণনা করেন।
প্লাস্টিক সার্জারি (নাক পুনর্গঠন) – এটি প্রাচীন ভারতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো।
ক্যাটাার্যাক্ট অপারেশন – সুশ্রুত সংহিতা অনুসারে সূক্ষ্ম সূচের মাধ্যমে চোখের ছানি অপসারণ করা হতো।
হাড় ভাঙার চিকিৎসা – ভেষজ মলম (হরিদ্র ও চুন) ও ব্যান্ডেজ দিয়ে হাড় পুনর্গঠনের পদ্ধতি ছিল উন্নত।
উপসংহার
ইতিহাসের চিকিৎসাবিদ্যা নানা অদ্ভুত পদ্ধতিতে পূর্ণ। যেখানে ইউরোপের চিকিৎসাবিদ্যা অনৈতিক ও ভয়াবহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেখানে ভারত প্রাকৃতিক ও নৈতিক চিকিৎসার ওপর জোর দিয়েছিল। আজকের দিনে আয়ুর্বেদ ও সিদ্ধ চিকিৎসার বহু পদ্ধতি এখনও কার্যকর ও জনপ্রিয়। আমাদের দুর্ভাগ্য পাশ্চাত্য যেভাবে সেই বিভীষিকাময় চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে আধুনিক চিকিৎসায় উন্নত হতে পেরেছে। আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতিকে কুসংস্কার, ছদ্ম বিজ্ঞান, অপ চিকিৎসার নামে পশ্চাৎগত করা হয়েছে।
আমাদেরই আর্টিকেল সম্পর্কে আপনার মতামত কি? যে কমেন্ট সেকশনে লিখে জানান।
0 Comments: