পুনর্জন্মবাদ— সৃষ্টির আদিতে প্রথম যে জীব জন্মেছিল তার জন্ম কিভাবে হয়েছিলো?
যদি কর্মের ফল ভোগ করতে পুনর্জন্ম হয়। তবে প্রথম যে জীব জন্মেছিল তার জন্ম কিভাবে হয়েছিলো? ভালো কর্মের জন্য স্বর্গ আর খারাপ কর্মের জন্য নরক এটা মূলত সব ধর্মেই বলে। এক জীবনে যদি ঝামেলা শেষ হতে পারে তবে পুনর্জন্মের প্রয়োজন কি? এর কি যুক্তি? তাহলে সৃষ্টির প্রথম জীব কোন কর্ম ফল ভোগ করতে জন্মেছিল?
এক কথায় উত্তর— "ভগবত ইচ্ছা"। ঈশ্বরের ইচ্ছা থেকে জগতের উৎপত্তি হয়েছে। বৃষ্টির প্রথম জীব তার ইচ্ছাতেই প্রকঠিত হয়েছে। তার ইচ্ছাতেই জগৎ পরিচালিত হচ্ছে। তার ইচ্ছাতেই, জগৎ লয় প্রাপ্ত হবে। আরো নিখুঁত ভাবে বললে। স্বয়ং ঈশ্বরই জগৎ হয়েছেন। তাই প্রতিটি জীব তারই বিস্তার। অতএব, জীবের ইচ্ছা থেকে পুনর্জন্ম হয়, কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছায় জীবের মুক্তি হয়।
পুনর্জন্ম কি?
ঋগ বেদে বলা হয়েছে। "একোহম বহুস্যাম" অর্থ হলো 'আমি এক, থেকে বহু হবো।
শ্লোক ৬.২.১
সদৈব সৌম্য ইদমগ্র আসীত একমেবাদ্বিতীয়ম। তদ্ধৈক আহুরসদৈবেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম তস্মাদসতঃ সজ্জায়ত॥
বাংলা অনুবাদ: হে সৌম্য (শিষ্য), সৃষ্টির প্রারম্ভে কেবলমাত্র "সৎ" (পূর্নতা) ছিল। সেটি এক এবং অদ্বিতীয়। তবে কিছু লোক বলে, 'আহুরসদৈবেদমগ্র' সৃষ্টির আগে সেই দেব "অসৎ" (শূন্যতা) ছিল । সেই "অসৎ" থেকেই "সৎ" উদ্ভূত হয়েছিল।
উক্ত শ্লোকটি আমাদের পরিচয় করায় যে পূর্বে দুটি মত প্রচলিত ছিলো। একপক্ষ বলতো আদিতে কেবল সৎ অস্তিত্বে ছিল। সেই থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, আরেক পক্ষ বলতো আদিতে কেবল অসৎ ছিলো। অসৎ থেকে সৎ তারপরে সৎ থেকে জগত সৃষ্টি হয়েছে।
শ্লোক ৬.২.২
কুতস্তু খলু সৌম্যৈংস্যাদিতি হোভাচ। কথমসতঃ সজ্জায়েতি। সত্ত্বৈব সৌম্য ইদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম॥
বাংলা অনুবাদ: হে সৌম্য, কোথা থেকে এই সৃষ্টি (অসৎ বা সৎ) আসতে পারে? সৃষ্টির পূর্বে কেবল "সৎ" (অস্তিত্বশীল) ছিল।
আজ যে জগতকে আমরা অনুভব করছি। সেই জগত হলো সৎ বা পূর্ণ, এবং এই সত্যতার অভাব হলো অসৎ। বা শূন্যতা। শূন্যতার কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদম্ পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে। পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে॥ আদিতে শূন্যতা বা পূর্ণতা এক এবং অদ্বিতীয় অবস্থায় ছিলো।
ঈশোপনিষদ বলছে:
পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদম্ পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে। পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে॥
"এই পূর্ণ, পূর্ণ থেকে এই সৃষ্টি। পূর্ণ থেকে পূর্ণ উদ্ভূত হয়।পূর্ণ থেকে পূর্ণ গ্রহণ করলে, যা অবশিষ্ট থাকে সেটিও পূর্ণ।" যেহেতু বহ্ম ( বা আত্মা) পূর্ণ তাই, ব্রহ্ম সত্য জগত মিথ্যা।
শ্লোক ৬.২.৩
তদৈক্ষত বহু স্যাঁ প্রজায়েয়েতি। তত্তেজোऽসৃজত। তত্তেজ ঐক্ষত বহু স্যাঁ প্রজায়েয়েতি। তদপোऽসৃজত। তস্মাদ্যত্র ক্বচ শোচতি স্বেদতে বা পুরুষস্তেজস এৱ তদধ্যাপো যায়ন্তে॥
বাংলা অনুবাদ: তখন সেই একমেবাদ্বিতীয় সত্তা (ব্রহ্ম) চিন্তা করলেন, "আমি বহু হবো, আমি সৃষ্টি করবো।" তখন তাঁর তপ বা তেজ সৃষ্টি হলো। সেই ব্রহ্ম তেজ বহু হওয়ার ইচ্ছা করে জল (নার) সৃষ্টি হল। "সেই (তস্মাৎ) সময় যখন (যত্র) কোথাও (ক্বচ) শরীর উত্তপ্ত হয় বা ঘর্মক্ষরণ হয় (শোচতি স্বেদতে), তখন সেই ব্যক্তি (পুরুষঃ) তার তেজ (তেজস) থেকে উৎপন্ন জলের (আপঃ) মাধ্যমেই পরিচিত হয় (তদধ্য যায়ন্তে)।"
এই শ্লোকের মাধ্যমে তেজ (শক্তি) এবং আপ (জল)-এর অন্তর্নিহিত সংযোগ এবং প্রাকৃতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি শুধু শারীরিক প্রক্রিয়া নয়, বরং সৃষ্টির মৌলিক উপাদানগুলির পারস্পরিক সম্পর্কও প্রকাশ করে।
অগ্নি থেকে জল উৎপন্ন হয়েছে — শুনেই অনেকে উপহাস করতে পারে। তাই বলে রাখি বায়ুতে স্পর্শ তন্মাত্র আছে বায়ুর কোন রূপ নেই। বায়ুকে চোখে দেখা যায় না। অগ্নিতে স্পর্শ এবং রূপ তন্মাত্র আছে। তাই অগ্নির স্পর্শ অনুভব করা যায় এবং রূপ চোখে দেখা যায়। অগ্নিতে রস তন্মাত্র নেই। তাই, রসের তন্মাত্র অগ্নির দ্বারা প্রকট হয়েছে, এমন বলা হয়েছে।
যৌক্তিক দিক:
1. বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপট:
আধুনিক বিজ্ঞানে বলা হয়, অগ্নি ও তাপের প্রভাবে বস্তুর গঠন পরিবর্তন হয়।
উদাহরণস্বরূপ:
তাপ দিলে বরফ গলে জল হয়। উত্তপ্ত বস্তু থেকে বাষ্প তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে জল হয়।
2. দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি:
এটি কেবল জৈবিক বা রসায়নিক পরিবর্তন নয়; বরং এটি শক্তির রূপান্তরের প্রতীক, যা প্রকৃতির মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক প্রকাশ করে।
শ্লোক ৬.২.৪
তা আপ ঐক্ষন্ত বহুয়ঃ স্যাঁ প্রজায়েমহীতি। তা অন্নমসৃজন্ত। তস্মাদ্যত্র ক্ব চ বর্ষতি তদেব ভূয়িষ্ঠমন্নং ভবতি অদ্ভ্য এৱ তদধ্যন্নাদ্যং যায়তে॥
বাংলা অনুবাদ: তারপর জল চিন্তা করল, "আমরা বহু হবো, আমরা সৃষ্টি করবো।" এরপর তারা অন্ন (খাদ্য) সৃষ্টি করল। এই কারণেই যেখানে জল বর্ষণ হয়, সেখানে অধিক অন্ন উৎপন্ন হয়। কারণ অন্ন মূলত জলের মাধ্যমেই জন্মায়।
শ্লোক ৬.৮.৭
স য এষোऽণিমৈতদাত্ম্যমিদং সর্বং তৎসত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো॥
বাংলা অনুবাদ: এই অনু (ক্ষুদ্রতম সত্তা এক এবং অদ্বিতীয়) সমস্ত সৃষ্টির মূল। এই সমগ্র জগৎ তাঁর দ্বারা বিদ্যমান। সেটিই সত্য বা পূর্ণ, সেটিই জীবের আত্মা। হে শ্বেতকেতু, তুমিই সেই আত্মা।
অর্থাৎ, জীবের আসল স্বরুপ হলো সেই ব্রহ্ম, জিনি পূর্ণ।যার ইচ্ছাতেই জগত সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর কি কোনো অভাব ছিলো যে তিনি জগত সৃষ্টি করলেন? না তিনি আনন্দ করবেন বলে জগত সৃষ্টি করলেন। এবং তিনি জগতের মধ্যে চেতনা রূপে প্রবেশ করলেন। তাঁর ইচ্ছায় এই সৃষ্ট জগতের প্রতিটি সৃষ্ট সত্ত্বা নিজ চেতনায় নিজেকে অপূর্ণ বোধ করেন। পরমাণু থেকে বিরাট গৃহ নক্ষত্র। সকলেরই একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বিকর্ষণ আছে। তাই, জীব অপূর্ণতা পূর্ণ করতে বহু বিধ চেষ্টা করে। নিজ নিজ অংশীর মতো অংশ পূর্ণ হওয়ার ইচ্ছায়। জড় থেকে জীব সকলেই বিবিধ কর্ম করে।
প্রতিটি চেষ্টা বহির্মুখী হওয়ায় তারা নতুন নতুন মিথ্যা বা মায়ার সৃষ্টি করে এবং পুনঃ পুনঃ নতুন নতুন রূপ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। এটাই পুনর্জন্ম।
পুনর্জন্মের প্রমাণ কি?
জন্মের পর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। সৃষ্টির পর কোন বস্তু চিরকালের জন্য অক্ষত থাকেনা। যেভাবে একটি মাটির পাত্র। তৈরি হওয়ার পর, একদিন সেটা ভেঙে যায়। ভেঙে যাওয়া মাটির পাত্র পুনরায় মাটিতে মিশে যায়। সেই মাটি দিয়ে হয়তো আবার নতুন কোন মাটির পাত্র তৈরি হয়। যে মাটি দিয়ে আজকে হাড়ি তৈরি হয়েছে, সেই মাটির একটি ভেঙে মাটির কলসি তৈরি হবে।
সেভাবেই ব্রহ্মের সেই, অখন্ড অংশ, যাহাকে আত্মা বলা হয়। সেই আত্মা মানব দেহ ধারণ করে মৃত্যুবরণ করে। পুনরায় তার নতুন জন্ম হয়। নতুন দেহে, পূর্ব জন্মের কিছু সুকৃতি এবং প্রারব্ধ প্রকাশ পায়। যেমন: যে কোন শাস্ত্রীয় সংগীত বা বাদ্যযন্ত্র। মনে করা, যাক তবলা। তবলা বাজানো শিখতে গুরুর কাছে তালিম নিতে হয়। ৫-৬ বছর তালিমের পর কেউ ভালো মতন তবলা বাজাতে শেখে।
কিন্তু, ইন্টারনেটে দেখলাম একজন শিশু যার বয়স মাত্র চার বছর। সে সেই ছোট থেকেই মাতব্বরের মতো তবলা বাজাচ্ছে। এত কম সময়ে সে কিভাবে তবলা বাজাতে পারে। এখানে তার থেকে বয়স্ক মানুষেরা, সেটা শিখতে ১২ বছর লাগবে! মাত্র পাঁচ বছর বয়সে, একজন বালক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে কিভাবে?
এগুলোকে আমরা প্রমাণ হিসেবে মানতে পারি। এছাড়াও। এরকম অনেক প্রমাণ আছে, যেখানে বহু বালক বালিকা পূর্ব জন্মের স্মৃতি ফিরে পেয়েছে। এবং অদ্ভুতভাবে সেই জায়গা বা পূর্বজন্মের মানুষ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যা জানা গেছে। তা তাদের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। পুনর্জন্ম না হলে এটা কিভাবে সম্ভব?
পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কি?
পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি, যা মোক্ষ নামে পরিচিত, হিন্দু দর্শনের চারটি প্রধান পুরুষার্থ (ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ)-এর একটি। এটি জীবের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং চিরস্থায়ী সুখের সন্ধান। মোক্ষের ধারণা বহু প্রাচীন শাস্ত্র, বেদ, উপনিষদ ও গীতায় বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এই ব্লগে আমরা হিন্দু শাস্ত্রের আলোকে পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি লাভের পদ্ধতি এবং দর্শন ব্যাখ্যা করব।
পুনর্জন্ম ও মোক্ষ: শাস্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি
হিন্দু ধর্ম অনুসারে, পুনর্জন্ম (সংশার) একটি অবিচ্ছিন্ন চক্র, যা কর্ম এবং সংশার ফলের দ্বারা পরিচালিত। এই চক্র থেকে মুক্তিই মোক্ষ। শাস্ত্র মতে:
संसारोऽयं दुःखमयः।(সংসারটি দুঃখময়।)
এই চক্র থেকে মুক্তি পেতে আত্মার প্রকৃতি ও পরম সত্তার মধ্যে সম্পর্ক উপলব্ধি করতে হবে। বেদান্ত শাস্ত্র বলছে:
ब्रह्म सत्यम्, जगन्मिथ्या, जीवो ब्रह्मैव नापरः।(ব্রহ্মই সত্য, জগত মিথ্যা, এবং জীব ব্রহ্মরই অংশ।)
মুক্তি লাভের পদ্ধতি
(আমাকে অসত্য থেকে সত্যে, অন্ধকার থেকে আলোতে, এবং মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে নিয়ে চলো।)
(আমাকে লাভ করলে মানুষ আর পুনর্জন্ম লাভ করে না। তারা চিরস্থায়ী মুক্তি পায়।)
মুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্য
মোক্ষ অর্জন মানে শুধুমাত্র পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি নয়; এটি হলো পরম আনন্দ (পরমানন্দ) লাভ করা। শাস্ত্র বলে:
এই "নিজেকে জানা" মানে নিজের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করা, যা ব্রহ্মর সঙ্গে একাকার।
উপসংহার
সৃষ্টির আদিতে প্রথম জীবের উৎপত্তি নিয়ে পুনর্জন্মবাদ ও হিন্দু দর্শন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। ঋগ্বেদ থেকে উপনিষদ এবং মনুস্মৃতির শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী, প্রথম জীবের উৎপত্তি ঈশ্বরের ইচ্ছা ও সৃষ্টির চক্রের একটি স্বতঃসিদ্ধ অংশ। এটি কর্মের ফল নয়, বরং এক শাশ্বত সত্যের প্রকাশ। সৃষ্টির চক্রে জীবের ধারাবাহিক পুনর্জন্ম কর্মফলের ওপর নির্ভরশীল হলেও প্রথম জীবের সৃষ্টিতে পরমাত্মার ইচ্ছাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই ধারণা আমাদের স্মরণ করায় যে, পুনর্জন্ম চক্রের বাইরে গিয়ে পরম সত্তার সঙ্গে একাত্ম হওয়াই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
জীবনকে শুদ্ধ করতে হলে নিয়মিত শাস্ত্র অধ্যয়ন, গুরু-উপদেশ গ্রহণ, এবং সৎকর্ম পালন অত্যন্ত জরুরি। মুক্তি হলো চিরন্তন আনন্দ ও শান্তির পথ।
0 Comments: