Headlines
Loading...
ভারতের বর্ণ প্রথা কিভাবে কাজ করতো?

ভারতের বর্ণ প্রথা কিভাবে কাজ করতো?

ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ — এই চারটি হলো হিন্দু জীবনের পুরুষার্থ বা পূর্ণতা। ধর্ম শিক্ষার বিষয়, অর্থ জীবন নির্বাহের উপকরণ, কাম হলো উৎপাদনের পরিকল্পনা এবং মোক্ষ হলো জীবনের মূল উদ্দেশ্য— “ধ্যান মূলং গুরু মূর্ত্তি,পূজা মূলং গুরু পদং, মন্ত্র মূলং গুরু বাক্যং, মোক্ষ মূলং গুরু কৃপা”।

ধর্মের মূর্তিমান পূরুষ গুরু মূর্তি হৃদয়ে ধারণ করে, উপার্জিত অর্থ  গুরুর চরণে সেবার নিমিত্ত করাই গুরুর পূজা, গুরুর বাক্যকে মন্ত্রের মতো পালন করে নিজের কামনাকে সুপথে চালিত করে, গুরু কৃপায় মোক্ষ লাভ হয়।

গুরু কে?

গুরু তাঁকে বলা হয়: যিনি ইষ্ট মন্ত্র দীক্ষা দেন, তিনিই গুরু । গুরু শব্দকে বিশ্লেষণ করলে গু ও রু এই দুইটি অক্ষর পাওয়া যায়। ‘গু’ মানে ‘অন্ধকার’ বা ‘অজ্ঞান’, আর ‘রু’ মানে ‘আলো’ বা ‘মুক্তি’। একজন গুরু তাঁর কৃপায় ভক্তকে এই অজ্ঞানময় মায়ার সংসার থেকে মুক্তি দেন। গুরু মাত্রই ব্রাহ্মণ হতে হবে, কিন্তু ব্রাহ্মণ মানেই গুরু নয়। 

শিক্ষক কে?

শিক্ষক তাঁকে বলা হয়, যিনি নিত্য কর্মের শিক্ষা দেন। যেমন, সন্ধ্যা আরতি, পূজা পদ্ধতি, যজ্ঞ, যপ, নিয়ম, সুচিতা, নীতি, দেশাচার, লোক ব্যবহার, ইত্যাদি।

আচার্য কাকে বলে?

আচার্য তাঁকে বলা হয়, যার আচরণ অনুকরণ যোগ্য। অর্থাৎ, ছাত্র বা ব্রহ্মচারী নিজ গৃহ ত্যাগ করে, যার বাড়ীতে বাস করে। তিনি যেভাবে সংসার ধর্ম পালন করেন। তাঁর সঙ্গে থেকে তাঁর শুদ্ধ ও  পবিত্র আচরণ ওই ছাত্র বা ব্রহ্মচারীরা নিজের দাম্পত্য জীবনের জন্য শিক্ষা নেয়। গুরুই আচার্য।

অধ্যক্ষ কাকে বলে?

অধ্যক্ষ বা অধ্যাপক হলেন, একজন বিপ্র, যিনি শিক্ষার্থীর বিদ্যা বা শিক্ষার জন্য গুরুর আশ্রমে অধ্যবসায় পরায়ণ হয়ে অধ্যাপনা করেন, আশ্রমের পরিচর্যা, গুরু সেবা ও ছাত্রদের অধ্যাপনার কাজ করেন। গুরু নিজেও অধ্যাপক হতে পারেন।

বর্ণ উৎপত্তি

গীতায় ভগবান বলছেন, চার বর্ণের উৎপত্তি তিনি গুণ ও কর্মের বিভাগ দ্বারা করেছেন। বেদ বলছে ঈশ্বরের পা শূদ্র, বাহু ক্ষত্রিয়, উদর বা জঙ্ঘা বৈশ্য এবং মুখ হলেন ব্রাহ্মণ। এই দুয়ের মধ্যে কোনটা সত্য মানবো? বর্ণ কি জন্মজাত নাকি কর্মজাত ?

দুটোই সত্য। বেদের ভাষায় বিরাট পুরুষ আমাদের সমাজ। যার মুখ, বহু, উদর এবং চরণ যথাক্রমে, জ্ঞান, শক্তি, সম্পদ ও শ্রম। এই চার প্রকার সেবায় নিযুক্ত মানুষ যথাক্রমে সাত্তিক, রাজসিক এবং তামসিক এই তিন গুণের অধিকারী হয়। এই হলো গুণ ও কর্মে নিয়োজিত বর্ণের উৎপত্তির কথা।

ঋষির পুত্রদের পিতৃ বলা হয়। বিভিন্ন পিতৃ থেকে দেবতা এবং জীব জন্ম হয়েছে। পুরাণ অনুসারে, বশিষ্ট ঋষির পুত্র সুকালীন শূদ্রদের পিতৃ ছিলেন। অর্থাৎ শূদ্ররাও ঋষির সন্তান যেভাবে ব্রাহ্মণ কব ঋষির পুত্র। আঙ্গীরা পুত্র হবিষ্মন্ত ছিলেন ক্ষত্রিয়দের পিতৃ। এভাবেই আমরা সকলেই ঋষিদের সন্তান। এই জন্মগত পরম্পরায় যে যেই বর্ণের তাঁর সেই বর্ণ নির্দিষ্ট।

মানুষ নিজ নিজ দক্ষতা অনুযায়ী নিজের জীবিকা ও কাজ ভাগ করে নিয়েছে। জীবিকা ছিলো পরিবার ভিত্তিক। সেই সময় কর্ম সংস্থান নিয়ে চিন্তা করতে হতো না।  তাই যুগ যুগ ধরে ভিন্ন ভিন্ন দেশে চলে আসছে। ভারতে শুধু নয় , সকল প্রাচীন দেশেই এই একই নিয়ম ছিলো।  আমাদের হিন্দু ধর্মে সবথেকে সন্মান ছিলো সাধু সন্ন্যাসী ও জ্ঞানীদের। 

বিচার করে দেখলে সমাজে সব থেকে সন্মান ছিল ব্রাহ্মণের। তাঁর জীবন ছিল কঠিন। নিষ্ঠা নীতি এবং ভগবানের প্রতি সমর্পনের কারণেই  ব্রাহ্মণের সন্মান করা হতো। মনুস্মৃতির তৃতীয় অধ্যায়ের ১০৩ নম্বর  শ্লোকে বলা হয়েছে, "চাটুকার ব্রাহ্মণকে অতিথি রূপে গ্রহণ না করতে।" মনু আরো বলেছেন, যে দ্বিজ অভিবাদনের প্রত্যাভিবাদন করেনা তাঁকে শূদ্র বলে উপেক্ষা করাই উচিত (মনুস্মৃতি: ২-এর ১২৫-১২৬)।  একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ সর্বদা গরীব ও থাকতো। ভিক্ষাবৃত্তি ও ভিক্ষান্ন ভোগ করেই  তাঁর জীবন অতিবাহিত হতো।

ব্রাহ্মণের আয় কিভাবে হতো?

যে রাজা, যে রাজ্যে শাসন করেন। তিনি সেই রাজ্যের বৈশ্য বা ধনপতি, জমিদার বা বিশপতিদের কাছে কর বা রাজস্ব আদায় করতেন। বিশপতি এবং ধনপতিরা রাজাকে যে রাজস্ব দান করতেন। রাজা সেই রাজস্ব থেকে কিছু অংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করতেন। যেমন, ছাত্রদের ছাত্রাবাস নির্মাণ, কাগজ, কলম, ঘটি-বাটি, কম্বল, খড়ম ইত্যাদি রাজা আশ্রমকে দান করতেন। 

তাই সকলের জন্য শিক্ষা ছিলো বিনা মূল্য। সাধারণ মানুষ শিক্ষার জন্য কোনো ব্যায় করতো না। এই ভাবেই ক্ষত্রিয় রাজা এবং বৈশ্য বিরাট পুরুষের মুখ স্বরূপ ব্রাহ্মণকে সেবা করতো।

ব্রহ্মচারীরা এবং অন্যান্য বিদ্যার্থীরা বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে অন্ন ভিক্ষা করে গুরুর কাছে নিয়ে আসতো। বিদ্যার্থীদের বলতে ক্ষত্রিয় রাজপুত্র এবং ক্ষত্রিয় বংশে জন্মানো ছাত্রদের বলা হচ্ছে।  বৈশ্য এবং শূদ্রের ভিক্ষা করতে হতো না। ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচারীরা ভিক্ষা করা অন্ন নিজেকে রান্না করে (স্বপাক) খেতে হতো। ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রের জন্য আলাদা করে একসাথে রান্না হতো। 

ভিক্ষার নিয়ম এরকম ছিলো— ব্রহ্মচারীকে প্রথম পাঁচ বাড়ীতে ভিক্ষা করতে হবে। যদি পাঁচটি বাড়িতে ভিক্ষা না জোটে। তবে ছয় নম্বর বাড়িতে যাওয়া যাবে না। একে মাধুকরী বলা হয়। মৌমাছি যেমন ফুলে ফুলে নিজের জন্য মধু সংগ্রহ করে। মধু জোগাড় না হলে খালিহাতে ফিরে যায়। ব্রহ্মচারী যদি ভিক্ষা না পায় সেই দিন ব্রহ্মচারী অভুক্তই থাকবে। গুরুর দয়া হলে শিষ্য অভুক্ত থাকবে না। শূদ্রের বাড়ি থেকে অন্ন ভিক্ষা করা নিষেধ ছিলো। কারণ সে সকলের সেবক। শূদ্রের বাড়ি থেকে অন্ন ভিক্ষা করলে  শূদ্রেকে শোষণ করা হয় । 

গৃহস্থ ব্রাহ্মণ পৌরহিত্যের দান ও দক্ষিণা দ্বারা সংসার চালায়। প্রয়োজনে সেও মাধুকরী করে নিজের জীবিকা অর্জন করে। কেবল মাত্র দক্ষিণার জন্য ব্রাহ্মণ পুরোহিত মূল্য ধরতে পারে। কিন্তু জোর জুলুম বা দামাদামি করতে পারে না। গৃহস্বামী যা দেবেন তাহাই দক্ষিণা। বেতন ভুক্ত ব্রাহ্মণ হয় না।

সকল বর্ণের বালক বালিকা প্রথমে গ্রামের ব্রাহ্মণ বাড়িতে গিয়ে মৌলিক শিক্ষা যেমন, অক্ষর জ্ঞান, ব্যাকরণ, শ্রোত্ত পাঠ ইত্যাদি শিখতো। এই গুলোকে টোল বলা হয়।

তারপর ছয় থেকে আট বছর বয়সে গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে, মাথা ন্যাড়া করে গুরুর আশ্রমে  ব্রহ্মচারী হয়ে বাস করতে হতো। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র সকলেই ওই গুরুর আশ্রমে থাকতো। গুরু তাঁর সন্তানের মতো তাদের লালন পালন করতো। চার বর্ণের মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য গুরুর কাছে বেদ পাঠের অধিকারী ছিলো। শূদ্রদের জন্য ছিলো পুরাণ, উপনিষদ, স্মৃতি শাস্ত্র শিক্ষা। 

বিদেশী আক্রমণ, রাজার পতনের কারণে গুরুকূল আশ্রাম গুলো কেবল ব্রাহ্মণদের জন্যই সংরক্ষিত হয়। এখন আশ্রম বলতে আমরা সাধারণত সাধু সন্ন্যাসীদের মঠ বুঝি।

বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়

এরপরের স্তর ছিলো বিদ্যালয়।  যোগ্যতা অনুযায়ী বিদ্যার্থীকে বিদ্যালয়ে দর্শন, গণিত, জ্যোতিষ, চিকিৎসা, বেদ, তন্ত্র, শিল্প, বাস্তু, সঙ্গীত, নৃত্য, ইত্যাদি বিদ্যার প্রশিক্ষণ  দেওয়া হতো। 

সেই সময় বিদ্যার প্রশিক্ষণ ও প্রয়োগ কেন্দ্র ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে রাজা তাঁর নিজের রাজকোষ থেকে অর্থ সামগ্রী ব্যয় করতেন। এখানে আস্তিক, নাস্তিক, জাত, পাত, ধর্ম, বর্ণের কোনো ভেদ ছিলো না। শিক্ষক এবং অধ্যক্ষরা এখানে সবাইকে শিক্ষা এবং বিদ্যা দান করতেন। বৌদ্ধ, জৈন,  বৈদিক, এমনকি ম্লেচ্ছ সকলেই জ্ঞান অর্জন করতে পারতেন। দেশ বিদেশের পন্ডিত জ্ঞানীরা এখানে আসতেন।  তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের প্রবেশিকা দিয়েই ঢুকতে হতো। 

Himadri Roy Sarkar always had a passion for writing. When he was younger, he would often write stories and share them with his friends. He loved the way that writing could bring people together and share ideas. In 2022, he founded The Hindu Network,The site quickly became popular, and Himadri was able to share his writing with people all over the world. The Hindu Network is now one of the most popular websites in the world, and Himadri is a well-known author and speaker. blogger external-link facebook instagram

0 Comments: