হিন্দু পূজা পদ্ধতি : আচমন, আসন শুদ্ধি, ৫ঞ্চশুদ্ধি, সামান্যার্ঘ্য স্থাপন ও জলশুদ্ধি ইত্যাদি
পূজা পদ্ধতি বলতে কোনো দেবদেবীর পূজা করার প্রক্রিয়া বা উপায় বোঝায়। পূজা কথার অর্থ। হলো পুনঃ পুনঃ জাগরণ। কার জাগরণ? আমাদের অন্তরে যে ঈশ্বর সত্ত্বা আছেন, যিনি বাইরেও আছেন সেই ঈশ্বরের জাগরণ। সেই চেতনা জন্য জ্ঞান, ভক্তি বা বিশ্বাস যথেষ্ট। ওই জ্ঞান, ভক্তি বা বিশ্বাস সঞ্চারের জন্য মন্ত্র, তন্ত্র এবং যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
পূজাও এক প্রকার যোগ। স্থূল আকারে সেটা ব্যক্তিগত উদ্যোগ মাত্র। উৎসৃঙ্খিল মনকে একাগ্র করার জন্য একটি বিশেষ প্রক্রিয়া।
পূজা সাধারণত হিন্দু ধর্মেই করা হয়, যেখানে নির্দিষ্ট নিয়ম ও প্রক্রিয়ায় ইষ্ট দেবতাদের আরাধনা করা হয়। প্রার্থনা বা ইবাদত পূজা নয়, সেটা। আলাদা বিষয়। পূজার পদ্ধতি পর্যালোচনা করলে আপনি বুঝতে পারবেন।
পূজা পদ্ধতি বিভিন্নভাবে পালন করা হয়, এবং এটি দেবতার নাম, পূজার উপলক্ষ্য, স্থান, ও সময়ের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। সাধারণত, একটি সাধারণ পূজা ২০ থেকে ৪৫ মিনিট সময় নিতে পারে। তবে, কিছু বিশেষ পূজা যেমন দুর্গাপূজা, লক্ষ্মী পূজা, বা কালী পূজা অনেক দীর্ঘ সময় ধরে চলে, যা এক ঘণ্টা থেকে কয়েক ঘণ্টাও হতে পারে।
আচমন
আচমন হলো পূজার বা যে কোনো পবিত্র কর্মের প্রথম কর্তব্য। ইহুদী এবং মুসলিমরা যেমন নামাজের আগে জল দিয়ে “উজু বা ওয়াজু" করে নিজেকে পবিত্র করে। সেভাবেই হিন্দুদের স্নান ও আচিমন দ্বারা নিজেকে পবিত্র করার বিধান আছে।
শাঁখচক্র ধরং বিষ্ণু মাধবো মাধবো হৃদি।স্মরন্তি সাধবো নিত্যং সর্ব কার্য্যেসু মাধ্বম্॥
সাধারণত স্নান ও আচমণ দিনে তিনবার করতে হয়। একেই ত্রি-সন্ধ্যা বলা হয়েছে। কিন্তু যে নিত্যপূজা অর্থাৎ বাড়িতে যে পূজা রোজ করা হয, তার আগে হাত মুখধুয়ে পবিত্র দেহে এবং পবিত্র বস্ত্র ধারণ করে পূজায় বসা উচিত। এরপর আচমণ করা জরুরী।
বিধান:
ডানহাতে একটিমাত্র মাষকলাই ডুবতে পারে এমন পরিমান জল গ্রহণ করে প্রণব মন্ত্র সহ “ওঁ বিষ্ণু” অথবা “নমঃ বিষ্ণু” তিন বার বলে ঐ জল তিন বার পান করতে হয়।
*(ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য ওঁ মন্ত্র উচ্চারণ করবে / নারী ও শূদ্ররা নমঃ বলবে) কারণ উপয়ন সংস্কার না হওয়ায় পর্যন্ত প্রণব উচ্চারণ করতে নেই। শূদ্র এবং নারীদের উপয়ন সংস্কার হয় না। উপয়ন সংস্কারের সময় বালককে নগ্ন হয়ে ভিক্ষা করতে হয়। নারীদের ক্ষেত্রে সেটা করানো সমীচীন নয়। এবং শূদ্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য এনাদেরও "দোষ" থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু সেই দোষ থেকে শূদ্র নিজে মুক্ত হতে পারে না। তাই শূদ্রদের উপয়ন সংস্কার হয় না।
তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বা নিরীক্ষণ করলেই স্নান ও সূর্য দর্শনের পূণ্য লাভ হয়। স্নানাং দর্কবিক্ষণম
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য এনাদেরও যদি উপনয়ন সংস্কার না হয়ে থেকে, তবে তারাও প্রণব বীজ মন্ত্র “ওঁ” উচ্চারণ করতে পারে না। করলে এর দ্বারা যজ্ঞ ফল নিষ্ফল হয়। অর্থাৎ কোনো কাজে দেয় না।
তারপর দুই হাত জোড় করে এই বৈদিক মন্ত্র পাঠ করতে হয়, যথা— “ওঁ তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ দিবীব চক্ষুরাততম।”
অর্থাৎ "আকাশে বিস্তৃত দিক্শক্তির ন্যায় বিষ্ণুর চক্ষু স্বরূপ সূর্য দেবের পরম পদ জ্ঞানি গণ সর্বদা স্মরণ করেন।"
তাই শুদ্ধির জন্য প্রথমেই বিষ্ণুকে স্মরণ করতে হয়।। কেন? কারণ, বেদে সূর্য ও চন্দ্র কে বিরাট পুরুষ নারায়ণের চক্ষু বলা হয়েছে। এই সূর্যই জগত পালন করছেন। সূর্য না থাকলে আমরা থাকতাম না। তাই তিনিই সকল জীবের আত্মা।
বিষ্ণুর পরম পদ বলতে মূলত সূর্যের তিনটি সন্ধ্যা বোঝায়। সূর্য উদয়ের সময়, মধ্যাহ্নের সময় এবং অস্ত যাওয়ার সময় তিনটি স্থানে থাকেন এবং এই তিনটি স্থানকেই তিনটি পদ রূপে কল্পনা করা হয়েছে।
বিষ্ণু বা সূর্য আলো দিয়ে অন্ধকার দূর করেন। এর পেছনে ধারনা এই— মনের যদি সূর্য বা বিষ্ণুর তেজ ধারণ করা যায়, তবে মনে আর অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা আসতে পারবে না। কোনো শুভ কর্ম শুরুতেই দেহ ও মন শুদ্ধ করার জন্য বিষ্ণুকে স্মরণ করা একান্ত আবশ্যক। পূর্বে উল্লেখিত মন্ত্রের সঙ্গে নিম্নোক্ত মন্ত্রও পাঠ করতে হয়, যথা—
অর্থাৎ —মানুষ পবিত্র বা অপবিত্র যে অবস্থায় থাকুক না কেন, সর্ব অবস্থায়ই পুণ্ডরীকাক্ষং অর্থাৎ পদ্মলোচন বিষ্ণুকে স্মরণ করলে বাহ্য দেহ ও অন্তর মন শুদ্ধ হয়।
এরপর সূর্যার্ঘ্য দিতে হয়। সুগন্ধি দ্রব্য (চন্দন বা অগরু), পুষ্প, আতপ তণ্ডুল (চাল), যব, তিল, শ্বেত সর্ষপ (সরিষা) এবং দূর্বার সমাবেশকে অর্ঘ্য বলে।
তবে অন্যান্য দ্রব্যের অভাবে কেবল আতপ তণ্ডুল ও দূর্বা দিয়ে অর্ঘ্য প্রদান করা যায়।
সূর্যার্ঘ্য প্রদানের জন্য কুশীর অগ্রভাদে দূর্বা, আতপ তণ্ডুল, রক্তচন্দন ও রক্তজবা অভাবে যে কোন লালবর্ণের ফুল সাজিয়ে নিম্নোক্ত মন্ত্রে সূর্যকে অর্ঘ্য প্রদান করতে হয়—
অর্থাৎ —"হে বিবস্বান সূর্য, তুমি জগৎ প্রকাশক, বিষ্ণুর তেজঃ সরূপ, জগৎ সৃষ্টিকারী, জগতের সকল বস্তুর প্রাণ স্বরূপ, প্রাণিজগতের কর্মে প্ররোচক সূর্যকে নমস্কার।
সূর্য নারায়নকে এই অর্ঘ্য প্রদানপূর্বক নমস্কার করে তারপর নিম্নোক্ত মন্ত্রে সূর্যকে প্রণাম করতে হয়।
অর্থাৎ জবা কুসুমের মত রক্তবর্ণ, কশ্যপের পুত্র, মহাদ্যুতি সম্পন্ন, অন্ধকারের শত্রু, সকল পাপনাশক দিবাকরকে আমি প্রণাম করি।
এরপর :
গন্ধাদির অর্চনা
গন্ধ বলতে মূলত চন্দনকেই বোঝায়। গন্ধাদ্রব্যের অর্চনার জন্য প্রথমে “বং এতেভ্যো গন্ধাদিভ্যো নমঃ” এই মন্ত্রে গন্ধাদির উপর তিন বার জল ছিটাতে হয়।
“বং” বীজ মন্ত্রটি স্বাধিষ্ঠান চক্রে বরুণ দেবতাকে নির্দেশ করে। তাই জল ছিটানোর সময় যে মন্ত্র পাঠ করা হয় তার শুরুতেই “বং” রয়েছে।
তারপর গন্ধপুষ্প (চন্দন মাখানো পুষ্প) দ্বারা নিম্নোক্ত মন্ত্র পাঠ করে সূর্য দেবের অর্চনা করতে হয়।
ওঁ এতৎ সম্প্রাদানায় পূজণীয় দেবতাভ্যো নমঃ।
অর্থাৎ এই গন্ধপুষ্প সহকারে গন্ধাদিকে প্রণাম, এসবের অধিপতি বিষ্ণুকে প্রণাম এবং এসব যাঁর উদ্দেশ্যে সম্পাদন করা হবে সে পূজনীয় দেবতাকে প্রণাম। প্রতিবার নমঃ বলার পরে একটি গন্ধপুষ্প পূজাপাত্রে রাখতে হয়।
গণেশাদির অর্চনা
যে কোন দেবতার পূজার পূর্বে গণেশের পূজা করা বিধেয়। গণেশ, বিষ্ণু, শিব, দুর্গা ও সূর্য এই পাঁচ জন দেবতাকে একত্রে পঞ্চদেবতা বলে।
পঞ্চদেবতা অনুসারে হিন্দু পাঁচটি সম্প্রদায় বিভক্ত। প্রতি সম্প্রদায় গনেশ পূজা করে নিজ নিজ ইষ্ট দেবতার পাসনা করেন। ক্রমে ক্রমে গণেশ, শিবাদি পঞ্চ দেবতা, নবগ্রহ, ইন্দ্র আদি দশদিকপালগণ, মৎস্য, কূর্ম, বরাহ আদি দশ অবতারগণ, কালী, তারা, ভুবনেশ্বরী প্রভৃতি দশমহাবিদ্যাগণ, গুরু, নারায়ণ এবং সর্ব দেবদেবীর অর্চনা করেন।
এই মন্ত্রে একেক দেবতার উদ্দেশ্যে একেকটি গন্ধপুষ্প পূজাপাত্রে অর্পণ করতে হয়।
স্বস্তিবাচন
পুরোহিত ছাড়া স্বস্তি পাঠ হয় না। কারণ, তিনি আদেশ করেন তারপর পালন করা হয়। স্বস্তিবাচনের বেদ বিভেদ অনুযায়ী আলাদা অলাদা বিধান আছে।
হাতে চন্দন মিশ্রিত আতপ চাল নিয়ে “ওঁ কর্তব্যেহস্মিন পূজনকর্মনি পুণ্যাহং ভবন্তো ব্রবন্তু” এই মন্ত্র তিন বার পাঠ করে ওঁ পুণ্যাহং তিন বার বলে তিন বার ঐ আতপ চাল ছিটাতে হয়। এরপর মন্ত্র:—
"ওঁ কর্তব্যেহস্মিন পূজনকর্মনি ঋদ্ধ্যতাং ভবন্তো ব্রবন্তু'
“ওঁ ঋদ্ধ্যতাং” তিনবার বলে তিনবার আতপ চাল ছড়াতে হয়।
পুনরায় আতপ চাল নিয়ে
"ওঁ কর্তব্যেহস্মিন পূজনকর্মনি স্বস্তি ভবন্তো ব্রবন্তু"
“ওঁ স্বস্তি” তিন বার বলে তিন বার আতপ চাল ছড়াতে হয়।
উপরি-উক্ত নিয়ম যজুর্বেদীয়দের জন্য। তবে ঋক্ ও সামবেদীয়রা প্রথমে পূণ্যাহং পরে স্বস্তি এবং শেষে ঋদ্ধিং বলে।
উপরি-উক্ত মন্ত্রের অর্থ করলে এমন হয়— এই কর্তব্যকর্মে এই পূজায় কর্মে আপনারা প্রথমবার স্বস্তি বলুন, স্বস্তি বলুন, স্বস্তি বলুন। দ্বিতীয়বার সমৃদ্ধি বলুন, সমৃদ্ধি বলুন, সমৃদ্ধি বলুন। পরিশেষে পূণ্যদিন বলুন, পূণ্যদিন বলুন, পূণ্যদিন বলুন।
সামবেদীয় পূজকের ক্ষেত্রে যে মন্ত্র পাঠ করতে হয় তা নিম্নরূপ।
আদিত্যং বিষ্ণুং সূর্যং ব্রহ্মাণঞ্চ বৃহস্পতিম্।।
—সাম-বেদ পূর্বার্চিক (১/১০/১)
অর্থাৎ আমাদের রক্ষার জন্য আমরা সোম, রাজা (ইন্দ্র), বরুণ, অগ্নি, আদিত্য বিষ্ণু, সূর্য, ব্রহ্মা ও বৃহস্পতিকে আহ্বান করি।
মন্ত্রটির ভাবার্থ এরকম— আমরা সেই শান্তিদায়ক, প্রকাশমান, পাপনাশক, জ্ঞানস্বরূপ, অখণ্ড, সর্বব্যাপক, সর্বপ্রকাশক এবং সর্বশ্রেষ্ঠ পালক পরমাত্মাকে নিত্য স্মরণ করি। পরে ওঁ স্বস্তি, ওঁ স্বস্তি, ওঁ স্বস্তি বলে তিন বার আতপ চাল ছিটাতে হয়। তারপর নিমোক্ত স্বস্তি-সূক্ত পাঠ করা হয়।
—সাম-বেদ উত্তরার্চিক (২১/৯/৩)
অর্থাৎ —বৃদ্ধশ্রবা (মহাকীর্তি) ইন্দ্র আমাদের মঙ্গল করুন, বিশ্ববেদা (সর্বজ্ঞ) পূষা আমাদের মঙ্গল করুন, অরিষ্টনেমি তাক্ষর্ (বিষ্ণু) আমাদের মঙ্গল করুন, বৃহস্পতি আমাদের মঙ্গল করুন।
এরপর সর্ববেদীয় পূজকগণকে কৃতাঞ্জলি পুটে নিম্নোক্ত সাক্ষ্য-মন্ত্র পাঠ করতে হয়।
অর্থাৎ সূর্য, সোম (চন্দ্র), যম, কাল, উভয় সন্ধ্যা, পঞ্চভূত, দিন-রাত্রি, পবন (বায়ু), ইন্দ্রাদি দিক্পাল, পৃথিবী, আকাশ, আকাশচর ও অমরগণ, ব্রহ্মের শাসন স্বীকার করে এখন এই স্থানে অবস্থান করুন। এই কার্য শুভ হোক।
দেবতাদের আবাহন করে তাঁদের সামনে সংকল্প করতে হয়। এবং এর পর সেই সংকল্প থেকেই ইষ্ট ফল প্রাপ্ত হয়।
সঙ্কল্প:
প্রত্যেক পূজার একটি উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য থাকে যা সঙ্কল্প নামে পরিচিত। তবে নিত্য পূজায় সঙ্কল্প প্রয়োজন হয় না। পূর্বমুখে বা উত্তরমুখে দক্ষিণ জানু দ্বারা ভূমি স্পর্শ করে কুশ, তিল, হরীতকী, পুষ্প ও জল তামার পাত্রে নিয়ে “বিষ্ণুঃ ওঁ তৎসৎ অদ্য অমুকে মাসি, অমুকে পক্ষে, অমুক তিথৌ, অমুক গোত্র, শ্রী অমুক দেবশর্মা, অমুক ফলপ্রাপ্তি কামনায় অমুককর্ম (পূজনং, ব্রতং) অহং করিষ্যামি” এই মন্ত্র পাঠ করতে হয়। অমুক জায়গার মাস, পক্ষ, তিথি, গোত্র, নাম ইত্যাদি বসানো হয়।
তারপর কুশের জল ঈশানকোণে ভূমিতে ফেলে তা তাম্রপাত্রের উপর উপুড় করে সামবেদীয়দের নিম্নোক্ত মন্ত্র পাঠ করা হয়।
— সাম-বেদ পূর্বার্চিক (১/৬/১)
অর্থাৎ দ্রবিণোদা দেব (অগ্নিদেব) তোমাদের পূর্ণ ভক্তি কামনা করেন। তাঁকে প্রীত কর, ভক্তি কর, তিনি তোমাদের ভার বহন করবেন।
আসন শুদ্ধি
আসন আধারশক্তি স্বরূপ কারণ আসনই পূজককে ধারণ করে অর্থাৎ আসনের উপরেই পূজক অধিষ্ঠান করেন। তাই আসনের বন্দনা করা একান্ত আবশ্যক। পূজকের বসার আসনের উপর প্রথমে একটি ত্রিকোণ-মণ্ডল অঙ্কিত করে “এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ হ্রীং আধারশক্তয়ে কমলাসনায় নমঃ” বলে একটি গন্ধপুষ্প আসনে অঙ্কিত ত্রিকোণ-মণ্ডলের উপর অর্পণ করতে হয়। তারপর আসন স্পর্শপূর্বক নিম্নোক্ত মন্ত্র পাঠ করতে হয়—
অর্থাৎ হে ধরিত্রীদেবী, তুমি সর্বলোককে ধারণ করে আছো। আবার তোমাকে স্বয়ং বিষ্ণু ধারণ করে আছে। তুমি নিয়ত আমাকে ধারণ করে থাক। আমি যেন কখনও তোমার কোল থেকে বিচ্যুৎ না হই। তুমি আমার আসনকে পবিত্র কর। পৃথিবী কত কষ্ট সহ্য করে প্রাণিকুলের ভার বহন করেন। পূজক আসনে বসলে আসন পূজকের ভার এবং পৃথিবী পূজক ও আসন উভয়ের ভার বহন করে। তাই পৃথিবী আসনে বসার পর পৃথিবী মাতাকে বন্দনা করা আবশ্যক।
পূজার এরকম বিধি-বিধান সত্যিই মহৎ ও উদার। কাউকে অসন্তুষ্ট রেখে পূজা করলে দেবতাও অসন্তুষ্ট হন। তাই আসন, মাটি থেকে শুরু করে পূজা-সংশ্লিষ্ট সকলকে তুষ্ট করলে দেবতাও তুষ্ট হন।
ঘট স্থাপন
পূজার সময় ঘটে দেবতারা এসে অবস্থান করবেন এরকম মনে করা হয়। মূর্তি না থাকলে শুধু ঘটে বা কলসে পূজা করা সম্ভব। মূর্তি থাকলেও ঘট প্রয়োজন। শুধু পূজনীয় দেবতাকেই মূর্তিতে পূজা করা হয়। কিন্তু পূজনীয় দেবতাকে পূজা করার সময় ঐ দেবতা ছাড়াও অন্যান্য দেবদেবীর পূজা করতে হয়। সব দেবদেবীর মূর্তি গড়া দুঃসাধ্য বলে পূজনীয় দেবতা ব্যতীত অবশিষ্ট দেবদেবীর পূজা ঘটে করা হয়। প্রথমে পঞ্চবর্ণের গুড়ি দ্বারা অষ্টদল পদ্ম অঙ্কন করে ঐ পদ্মের উপর মাটি এবং পঞ্চশস্য (ধান, মাষকলাই, তিল, শেতসরিষা এবং যব) ছড়িয়ে তার উপর ঘট স্থাপন করতে হয়। পঞ্চবর্ণের গুড়ি দ্বারা মূলত স্থান-শুদ্ধি করা হয়।
পঞ্চশস্য ও পঞ্চবর্ণের গুড়ি না থাকলে কেবল ধান ছড়িয়ে তার উপর ঘট স্থাপন করা যায়। ঘট জল দ্বারা পূর্ণ করে ঘটের মুখে পঞ্চপল্লব (আম, অশ্বত্থ, বট, পাকুড় ও যজ্ঞডুমুরের পাতা) দিতে হয়। ঘটের মধ্যে নবরত্ন বা পঞ্চরত্ন দেয়া বিধেয়। ঘটের উপর ফুল, একটি ফল (যেমন— সশীষ ডাব) ও বস্ত্র দেয়ার পর ঘটের বক্ষস্থলে সিন্দুর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন অঙ্কিত করতে হয়। ঐ স্বস্তিক চিহ্ন মূলত জীবাত্মার প্রতীক। তারপর ভূমি, ঘট, জল, পল্লব, ফল, সিন্দুর, ফুল ও বস্ত্র স্পর্শ করে মন্ত্রপাঠ করতে হয়। উক্ত কার্য শেষে দুই হাত দিয়ে ঘট স্পর্শ করে নিম্নোক্ত মন্ত্রে ঘট স্থিরীকরণ করা হয়।
অর্থাৎ হে দেব, আপনি সর্বতীর্থ থেকে উৎপন্ন জলপূর্ণ এবং সর্বদেবসমন্বিত ঘটে সহচরগণসহ এসে স্থিরভাবে বিরাজ করুন।
যে ঘটে সর্ব দেবদেবীর অধিষ্ঠান, সে ঘট মূলত হৃদয়-গুহারই প্রতীক। ঘটে বসিয়ে দেবতাকে পূজা করা হয় ঠিকই কিন্তু পূজক মনে মনে এই চিন্তা করে যে, তিনি হৃদয়-আসনে দেবতাকে বসিয়ে পূজা করছেন। ঘটের জল ভাব বা রসের, ফল বুদ্ধি বা জ্ঞানের, পঞ্চপল্লব পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয়ের, পঞ্চরত্ন পঞ্চ-জ্ঞানেদ্রিয়ের এবং পঞ্চশস্য পঞ্চ-তন্মাত্রের প্রতীক। ঘটের ঐ সিন্দুর দারা অঙ্কিত স্বস্তিক চিহ্ন সূক্ষদেহের অনুকল্প। সুতরাং ঘটে বাহ্যপূজার পশ্চাতে মনের মাঝেই দেবতার পূজা সম্পন্ন হয় যা পূজক ছাড়া অন্য কারো পক্ষে উপলব্ধি করা দুষ্কর। ঘট ও দেবতার মূর্তিকে পূর্ব বা উত্তর দিকে স্থাপন করা হয়। কারণ পূর্ব দিকে সূর্য উদিত হয় এবং উত্তর দিকে ব্রহ্মলোক অবস্থিত বলে পূর্ব ও উত্তর দিক অতি পবিত্র।
পঞ্চশুদ্ধি
পূজায় শুদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অশুদ্ধভাবে পূজা করলে দেবতা অসন্তুষ্ট হয় এবং পূজার ফলও মঙ্গলজনক হয় না। আত্মা বা পূজক, স্থান, মন্ত্র, দ্রব্য ও দেবতা এই পঞ্চ পদার্থের শুদ্ধিকে পঞ্চশুদ্ধি বলে। ভূতশূদ্ধি, প্রাণায়াম, ন্যাস প্রভৃতির দ্বারা আত্মা-শুদ্ধি করা হয়। ফুল, মালা প্রভৃতি সাজিয়ে ধূপ-দীপ জ্বেলে স্থান-শুদ্ধি করা হয়। যথাবিহিত উপায়ে অনুলোম, বিলোম প্রভৃতি ক্রমে মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে মন্ত্র-শুদ্ধি করা হয়। মন্ত্রোচ্চারণ ও বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে দ্রব্য-শুদ্ধি করা হয়। পূজাদ্রব্য, নৈবেদ্য, যথাবিধি মন্ত্র প্রভৃতি দ্বারা দেবতাকে শুদ্ধ করা হয়।
সামান্যার্ঘ্য স্থাপন ও জলশুদ্ধি
প্রথমে ভূমিতে জল দ্বারা ত্রিকোণ-মণ্ডল অঙ্কন করে গন্ধপুষ্প দ্বারা কূর্ম ও অনন্তরূপী পৃথিবী বা ভূমির পূজা করতে হয়। যথা— “এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ আধারশক্তয়ে নমঃ, ওঁ কূর্মায় নমঃ, ওঁ অনন্তায় নমঃ, ওঁ পৃথিব্যৈ নমঃ” বলে চারাবার গন্ধপুষ্প অর্পণ করতে হয়। সকলের আধার বা আশ্রয়দাত্রী বলে ভূমিকে আধারশক্তি বলা হয়। যেহেতু ভূমি সকলকে ধারণ করেন সেহেতু কৃতজ্ঞতাবশত তাঁর পূজা করা আবশ্যক।
যা হোক, এরপর “অস্ত্রায় ফট” মন্ত্রে কোশাটি ঐ ত্রিকোণ-মণ্ডলের উপর রেখে “ওঁ” মন্ত্র উচ্চারণ করে তিন বার জল দ্বারা কোশা পূর্ণ করতে হয়। কোশা জলপূর্ণ করার পর এর অগ্রভাগে একটি অর্ঘ্য স্থাপন করে “মং বহ্নিমণ্ডলায় দশকলাত্মনে নমঃ, অং অর্কমণ্ডলায় দ্বাদশকলাত্মনে, উং সোমমণ্ডলায় ষোড়শকলাত্মনে নমঃ”।
“ওঁ” মন্ত্রকে বিশ্লেষণ করলে হয়— অ + উ + ম। তাই “মং” বীজ মন্ত্রে দশকলাত্মক অগ্নিমণ্ডল, “অং” বীজমন্ত্রে দ্বাদশকলাত্মক সূর্যমণ্ডল এবং “উং” বীজমন্ত্রে ষোড়শকলাত্মক চন্দ্রমণ্ডলের পূজা করা হয়। সোম বা চন্দ্রের ষোড়শ-কলার নাম— অমৃতা, মানদা, পূজা, তুষ্টি, পুষ্টি, রতি, ধৃতি, শশিনী, চন্দ্রিমা, কান্তি, জ্যোৎস্না, শ্রী, প্রীতি, অঙ্গদা, পূর্ণা ও পূর্ণামৃতা।
বহ্নি বা অগ্নির দশ-কলার নাম— ধুম্র, অর্চিঃ, জ্বলিনী, সূক্ষ্ণা, জ্বালিনী, বিস্ফুলিঙ্গিনী, সুশ্রী, সুরূপা, কপিলা ও হব্যকব্যবহা। অর্ক বা সূর্যের দ্বাদশ-কলার নাম— তপিনী, তাপিনী, ধুম্রা, মরীচি, জ্বালিনী, রুচি, সুধুম্রা, ভাগদা, বিশ্বা, বোধিনী, ধারিণী ও যম। মূলত চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি এই তিন মণ্ডলকে বোঝাতেই ত্রিকোণ-মণ্ডল অঙ্কন করা হয় এবং এই ত্রিকোণ-মণ্ডলেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব অবস্থান করেন এরকম কল্পনা করতে হয়। জলশুদ্ধির জন্য প্রথমে কোশার জলে গন্ধ, পুষ্প ও দূর্বা প্রদান করে ধেনু-মুদ্রা দ্বারা অমৃতীকরণ, মৎস্য-মুদ্রা দ্বারা আচ্ছাদন এবং অঙ্কুশ-মুদ্রা দ্বারা তীর্থসমূহ আবাহন করা হয়। তীর্থ আবাহন মন্ত্রটি নিম্নরূপ।
নর্মদে সিন্ধুকাবেরি জলেহস্মিন্ সন্নিধিং কুরু।।
অর্থাৎ হে গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরি, সরস্বতি, নমর্দা, সিন্ধু ও কাবেরি, আপনারা এই জলে অধিষ্ঠান করুন। এভাবে মন্ত্রোচ্চারণের দ্বারা জল-শুদ্ধি করলে জল আর জল থাকে না, তা অমৃতে পরিণত হয়।
করশুদ্ধি
পূজক মূলত কর বা হাতের মাধ্যমেই পূজার সব কার্য করেন। তাই তাঁর হাত শুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। গন্ধপুষ্প নিয়ে “ঐং বং অস্ত্রায় ফট্” মন্ত্রে ঐ গন্ধপুষ্প দুই হাতে পেষণ (চূর্ণন) করে তা বামদিকে নিক্ষেপ করে জল ছিটাতে হয়।
পুষ্পশুদ্ধি
পুষ্পপাত্রের সব পুষ্প স্পর্শ করে “ওঁ পুষ্পে পুষ্পে মহাপুষ্পে সুপুষ্পে পুষ্পসম্ভবে। পুষ্পপ্রচয়াবকীর্ণে হূং ফট্ স্বাহা”
উক্ত মন্ত্রের অর্থ এরকম— হে পুষ্প, হে পুষ্প, হে মহাপুষ্প, হে সুপুষ্প, তোমরা পূজায় নিজেকে নিবেদন কর।
ভূতাপসারণ
ভূত-প্রেত যাতে পূজায় বিঘ্ন সৃষ্টি না করতে পারে, সেজন্য ভূতাপসারণ করা প্রয়োজন। মূলত ষড়-ঋপু নামক ভূতকে দূর করে চিত্তকে পরিশুদ্ধ করাই ভূতাপসারণের প্রকৃত উদ্ধেশ্য। ভূতাপসারণের জন্য সাদা সরিষা হাতে নিয়ে নিম্নোক্ত মন্ত্র পাঠ করতে করতে চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হয়।
অর্থাৎ পৃথিবীতে অবস্থানকারী যেসব ভূত বিঘ্ন সৃষ্টি করে শিবের নির্দেশে তাদের বিনাশ হোক। তারপর ভূমিতে তিন বার পদাঘাত করে এবং মাথার উপর তিন বার ফট্ মন্ত্রে করতালি দিয়ে ভূতাপসারণ ও তুড়ি দ্বারা দশদিক বন্ধন করতে হয়।
ভূতশুদ্ধি
ভূতশুদ্ধি বলতে মূলত দেহের পঞ্চভূতকে (মাটি, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ) শুদ্ধ করা বোঝায়। প্রথমে “রং” মন্ত্রে পূজককে তাঁর চারিদিকে জলধারা ছড়িয়ে দিতে হয়। তখন তিনি যেন অগ্নিপ্রাচীরের মধ্যবর্তী রয়েছেন এমন চিন্তা করতে হয়। বস্তুত মন্ত্রবলে পূজকের চারদিকের ছিটানো জলধারাই বহ্নি-প্রাচীরে পরিণত হয়, যে প্রাচীর ভেদ করে কোন অশুভ শক্তি প্রবেশ করতে পারে না। অগ্নি সব কিছু দহন করে শুদ্ধ করে। তাই পূজক মনে করবে যেন তাঁর পঞ্চভূত এবং অশুভ চেতনাগুলো অগ্নিতে পুড়ে শুদ্ধ হয়ে গেছে।
তারপর একাগ্র মনে “ওঁ মূলশৃঙ্গাটাচ্ছিরঃ সুষুম্না পথেন জীবশিবং পরমশিব পদে যোজয়ামি স্বাহা। ওঁ যং লিঙ্গশরীরং শোষয় শোষয় স্বাহা।।
ওঁ রং সঙ্কোচশরীরং দহ দহ স্বাহা। ওঁ পরমশিবং সুষুম্না পথেন মূলশৃঙ্গাটমুল্লসোল্লাস জ্বল জ্বল প্রজ্বল প্রজ্বল সোহহং হংসঃ স্বাহা।।”
-এই মন্ত্র পাঠ করতে হয়।
উক্ত মন্ত্রের অর্থ এরকম— মূলাধারের চতুর্দল পদ্মে অবস্থানরত জীবাত্মারূপী শিবকে সুষুম্না পথে জাগ্রত করে পরমাত্মারূপী শিবের সাথে মিলিত করছি। হে বায়ু, আমার লিঙ্গ-শরীরকে শোষিত কর। হে অগ্নি, আমার সূক্ষ্ম-শরীরকে দগ্ধ কর। হে অগ্নি, তুমি মূলাধারের চতুর্দল পদ্মে আনন্দের সাথে জ্বলে ওঠ, উত্তমরূপে জ্বলে ওঠ যেন ঘুমন্ত কুণ্ডলিনী (জীবাত্মা) জাগ্রত হয় এবং পরমাত্মা শিবের সাথে যুক্ত হয়ে আমিই সেই হংস (পরমাত্মা) এমন বোধ উৎপন্ন হয়।
মাতৃকান্যাস
মাতৃকা বলতে মূলত বাক্দেবী সরস্বতীকে বোঝায়। কোন বস্তুকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে ঐ স্থানে অন্য বস্তু স্থাপন করাই হল ন্যাস। মাতৃকা ন্যাসের মাধ্যমে মাতৃকা-সরস্বতী কতৃর্ক সৃষ্ট অ থেকে ক্ষ পর্যন্ত এই পঞ্চাশ বর্ণ দেহের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয়। দেবী সরস্বতীর কৃপা ব্যতীত মন্ত্র উচ্চারণ এবং দেবতার স্তবস্তুতি অসম্ভব। তাই মাতৃকা ন্যাসের মাধ্যমে সরস্বতী দেবীকে পূজকের দেহে স্থাপন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ন্যাসের মাধ্যমে পূজকের জীব-ভাবকে সরিয়ে দেবত্বকে স্থাপন করা হয়।
ব্যাপক ন্যাস
ওঁ অথবা মূল মন্ত্র উচ্চারণ পূর্বক হৃদয় হতে আরম্ভ করে পদযুগল পর্যন্ত এবং পদযুগল থেকে হৃদয় পর্যন্ত দুই হাত প্রসারিত করে গাত্রের নিকট সাতবার সঞ্চালন করতে হয়। এরকম সঞ্চালনই ব্যাপক ন্যাস। ব্যাপক ন্যাসের মাধ্যমে মন্ত্রসমূহ পূজকের সমস্ত শরীরে ব্যাপ্ত হয় বা ছড়িয়ে পড়ে অথার্ৎ পূজকের দেহ মন্ত্রময় হয়ে ওঠে।
করন্যাস
করের বিভিন্ন অংশে বীজ মন্ত্র স্থাপন করে তা শুদ্ধ করাই করন্যাসের উদ্দেশ্য। যেমন— চণ্ডী-পূজার ক্ষেত্রে করন্যাসের জন্য অঙ্গুষ্ঠ (বৃদ্ধাঙ্গুলি) স্পর্শ করে “হ্রাং অঙ্গুষ্ঠাভ্যাং নমঃ”, তর্জনী স্পর্শ করে “হ্রীং তর্জনীভ্যাং স্বাহা”, মধ্যমা স্পর্শ করে “হ্রূং মধ্যমাভ্যাং বষট্”, অনামিকা স্পর্শ করে “হ্রৈং অনামিকাভ্যাং হুং”, কনিষ্ঠা স্পর্শ করে “হ্রৌং কনিষ্ঠাভ্যাং বৌষট্” এবং করতল স্পর্শ করে “করতলপৃষ্ঠাভ্যাং অস্ত্রায় ফট্” মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়।
অঙ্গন্যাস
হৃদয়, শির (মস্তক), শিখা (টিকী), কবচ (বাহু), নেত্র এবং করতল-পৃষ্ঠে বীজ-মন্ত্র স্থাপন করাই হল অঙ্গন্যাস। যেমন— চণ্ডী পূজার ক্ষেত্রে “হ্রাং হৃদয়ায় নমঃ”, “হ্রীং শিরসে স্বাহা”, “হ্রূং শিখায়ৈ বষট্”, “হ্রৈং কবচায় হুং”, “হ্রৌং নেত্রত্রয়ায় বৌষট্” এবং “হ্রং করতলপৃষ্ঠভ্যাং অস্ত্রায় ফট্” মন্ত্র দ্বারা যথাক্রমে হৃদয়, শির, শিখা, বাহু, নেত্র এবং করতল-পৃষ্ঠে স্পর্শ করে অঙ্গন্যাস করা হয়।
সাধারণত দেবতার নামের প্রথম অক্ষর থেকেই এসব বীজ-মন্ত্র তৈরী হয়েছে। যেমন— শিব-পূজায় কর ও অঙ্গন্যাসের সময় শ্রাং, শ্রীং, শ্রূং, শ্রৈং এবং শ্রৌং মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়।
দ্বারদেবতাদির পূজা
যে দেবতাগণ দ্বার-রক্ষা করেন অর্থাৎ কোন অশুভ শুক্তিকে গৃহের মধ্যে প্রবেশ করতে দেন না, সেসব দ্বার-দেবতাগণের এবং বাস্তুপুরুষের পূজাও কর্তব্য। এজন্য পুষ্প নিয়ে
“এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ দ্বারদেবতাভ্যো নমঃ” এই মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক পুষ্পটি পূজাগৃহের দ্বারদেশে নিক্ষেপ করতে হয়। পরে “এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ ব্রহ্মণে নমঃ, এতে গন্ধপুষ্পে ওঁ বাস্তুপুরুষায় নমঃ”
মন্ত্রে পূজা করতে হয়।
গুরুপঙ্ক্তি প্রণাম
করজোড়ে (বামে) ওঁ গুরুভ্যো নমঃ, ওঁ পরম গুরুভ্যো নমঃ, ওঁ পরাপর গুরুভ্যো নমঃ, ওঁ পরমেষ্ঠি গুরুভ্যো নমঃ, (দক্ষিণে) ওঁ গণেশায় নমঃ, (ঊর্ধে) ওঁ ব্রহ্মণে নমঃ, (অধঃদিকে) ওঁ অনন্তায় নমঃ, (মধ্যে) ওঁ অমুক দেবতায়ৈ নমঃ এই মন্ত্র পাঠ করে স্থান স্পর্শ করে প্রণাম করতে হয়।
প্রাণায়াম
পূরক, কুম্ভক ও রেচকের মাধ্যমে প্রাণবায়ুকে নিয়ন্ত্রন করাকে প্রাণায়াম বলে। প্রাণায়ামের সময় “হংস” প্রভৃতি মন্ত্র দ্বারা শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রন করতে হয়। প্রাণায়াম ধ্যানের সহায়ক অঙ্গ।
আবাহন
দেবতাকে আহবান করাই হল আবাহন। ওঁ ভূভূর্বস্বঃ অমুকদেব বা দেবী (আবাহনী মুদ্রা দ্বারা) ইহাগচ্ছ ইহাগচ্ছ, (স্থাপনী মুদ্রা দ্বারা) ইহ তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ, (সন্নিধাপনী মুদ্রা দ্বারা) ইহ সন্নিরুধ্যস্ব, (সম্মুখীকরণী মুদ্রা দ্বারা) অত্রাধিষ্ঠানং কুরু এবং (কৃতাঞ্জলি পুটে) মম পূজা গৃহাণ বলে দেবতাকে আবাহন করা হয়।
চক্ষু-দান ও প্রাণ-প্রতিষ্ঠা
চক্ষু-দান ও প্রাণ-প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত দেবতার মূর্তি জড় পদার্থ ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু চক্ষু-দান ও প্রাণ-প্রতিষ্ঠার পরে মূর্তি চৈতন্যময় হয়ে ওঠে। প্রাণ-প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূজকের নিজের আত্মসত্ত্বা বা প্রাণকে প্রতীমায় স্থাপন করতে হয়। পূজক নিজের প্রাণকে প্রতীমায় অর্পণ করলে প্রতীমা যেমন চৈত্যন্যময় হয় তেমনি পূজকের দেহও হয়ে ওঠে দেবময়। প্রাণ-প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মূলত পূজকের অন্তরের দেবতাকেই প্রতীমায় আরোপিত করা হয়।
মানস-পূজা
শাস্ত্রমতে বাহ্য-পূজা ও মানস-পূজার মধ্যে মানস পূজাই শ্রেষ্ঠ। মানস-পূজার সময় বক্ষঃস্থলে বামহস্তের উপর দক্ষিণ হস্ত স্থাপন করে বাক্য, মন ও হৃদয় দ্বারা দেবতার পূজা করা হয়। মানস-পূজার সময় পূজককে চিন্তা করতে হয় যেন দেহের মধ্যেই পূজার সব উপকরণ আছে। মানস-পূজায় আসন— হৃদপদ্ম, পাদ্য— সহস্রদল থেকে গলিত সোমরস বা অমৃত, অর্ঘ্য— মন, আচমনীয়— পূর্বোক্ত অমৃত, স্নানীয়— উক্ত অমৃত, বস্ত্র— দেহ মধ্যস্থ আকাশতত্ত্ব, গন্ধ— ক্ষিতিতত্ত্ব, পুষ্প— বুদ্ধি, ধূপ— প্রাণবায়ু, দীপ— দেহস্থ অগ্নিতত্ত্ব, নৈবেদ্য— হৃদয়ে কল্পিত সুধামৃত, বাদ্য— বক্ষ স্থলের শব্দ (অনাহত ধ্বনি), চামর— বায়ুতত্ত্ব, ছত্র— সহস্রদল পদ্ম, গীত— শব্দতত্ত্ব এবং নৃত্য— ইন্দ্রিয় কর্ম।
ধ্যান
সকল ব্যাহ্যচিন্তা মন থেকে সরিয়ে কেবলমাত্র দেবতার রূপ চিন্তা করাই ধ্যান। প্রতীমা নয় মূলত অন্তরের কল্পিত দেবতাকেই পূজা করা হয়। বাইরের ঐ প্রতীমা ধ্যানে সহায়ক। প্রতীমার দর্শনে মনের মধ্যে দেবতার রূপ ভেসে ওঠে। তাই প্রতীমারও বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। তবে যে পূজক অন্তরে সহজেই দেবতার রূপ কল্পনা করতে পারে তার বাহ্য-প্রতীমার প্রয়োজন হয় না। কূর্ম (কচ্ছপ) তার মস্তককে ভিতরের দিকে প্রবেশ করাতে পারে। ইন্দ্রিয়গণ মস্তকেই অবস্থান করে। তাই মস্তককে অন্তরমুখী করলে ইন্দ্রিয়গণকেই অন্তরমুখী করা হয়। যোগ-ধ্যান করার সময় বহির্মুখী ইন্দ্রিয়গণকে অন্তরমুখী করতে হয়। তাছাড়া কূর্ম শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রন করে অনেকদিন বেঁচে থাকে। তাই কূর্ম হল যোগধ্যানের প্রতীক। এজন্য কূর্ম-মুদ্রায় ফুল নিয়ে ধ্যান করা হয়।
উপাচার
পঞ্চোপচার, দশোপচার, ষোড়শোপচার এবং অষ্টাদশোপচারে সাধারণত পূজা করা হয়। পঞ্চোপচার হল— ১) গন্ধ (চন্দন), ২) পুষ্প, ৩) ধূপ, ৪) দীপ ও ৫) নৈবেদ্য। দশোপচার হল— ১) পাদ্য, ২) অর্ঘ্য, ৩) আচমনীয়, ৪) পুনরাচমনীয়, ৫) গন্ধ, ৬) পুষ্প, ৭) বসন, ৮) ধূপ, ৯) দীপ ও ১০) নৈবেদ্য। ষোড়শোপচার হল— ১) আসন, ২) স্বাগত, ৩) পাদ্য, ৪) অর্ঘ্য, ৫) আচমনীয়, ৬) মধুপর্ক ৭) স্নানীয়, ৮) বসন, ৯) আভরণ, ১০) গন্ধ, ১১) পুষ্প, ১২) ধূপ, ১৩) দীপ, ১৪) নৈবেদ্য, ১৫) পুনরাচমনীয়, ও ১৬) তাম্বুল (পান)। অষ্টাদশোপচার হল— ১) আসন, ২) স্বাগত, ৩) পাদ্য, ৪) অর্ঘ্য, ৫) আচমনীয়, ৬) মধুপর্ক ৭) স্নানীয়, ৮) যজ্ঞোপবীত, ৯) আভরণ, ১০) গন্ধ, ১১) পুষ্প, ১২) ধূপ, ১৩) দীপ, ১৪) অন্ন, ১৫) দর্পণ, ১৬) মাল্য, ১৭) অনুলেপন (গন্ধদ্রব্য) এবং ১৮) নমস্কার ও বিসর্জন। ধূপ প্রতীমার ডানদিকে এবং দীপ প্রতীমার বামদিকে রাখতে হয়।
পূজায় উপাচার অর্পণের বিষয়টি এসেছে অতিথি-সৎকারের প্রথা থেকে। প্রাচীনকালে গৃহে কোন অতিথি এলে তাকে স্বাগতম জানানো হত, পাদ্য (পা ধোয়ার জল), এবং আচমনীয় (হাত-মুখ ধোয়ার জল) দেয়া হত। তারপর তাঁকে আসনে বসিয়ে জ্যেষ্ঠ হলে পায়ে এবং কনিষ্ঠ হলে মস্তকে অর্ঘ্য প্রদান করা হত। অর্ঘ্য-প্রদান শেষে তার জন্য মধুপর্ক (দধি, ঘৃত, মধু, শর্করা ও জলের মিশ্রণ) নামক এক ধরনের জল খাবার দেয়া হত। তারপর তার স্নানের জন্য স্নানীয় জল এবং পরিধেয় বস্ত্র প্রদান করা হত। স্নানশেষে অতিথির আহারের ব্যবস্থা করা হত।
আহার শেষে অতিথিকে পুনরায় আচমন করার জন্য পুনরাচমনীয় দেয়া হত। পূজনীয় দেবতাও যেন অতিথি। তাই তাঁকে ভক্তিপূর্ণ সেবা-যত্ন করা একান্ত কর্তব্য। দেবতাকে সেবা-যত্ন করে নৈবেদ্য (দেবতার ভোজ) নিবেদন করে পরিশেষে প্রণামের মাধ্যমে পূজা শেষ হয়। উপাচার দান করারও একটি নিদিষ্ট বিধান রয়েছে। উপাচার পুংলিঙ্গবাচক শব্দ হলে তার পূর্বে “এষ” হয়, যেমন— এষ ধূপ এবং স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ হলে তার পূর্বে এষা ব্যবহৃত হয়, যেমন— এষা দূর্বা। উপাচার ক্লীব-লিঙ্গ হলে তার পূর্বে এতৎ বা ইদং ব্যবহার করতে হয়, যেমন— এতৎ পাদ্যং, ইদম্ আচমনীয়ম্। যেমন— গণেশ-পূজার ক্ষেত্রে উপাচার দান করতে হয় এভাবে
উপাচার দানের তাৎপর্য
পূজক পূজায় দেবতাকে পঞ্চ-উপাচার প্রদানের মাধ্যমে মূলত পঞ্চভূতকেই প্রদান করেন। যেমন— গন্ধদ্রব্য ক্ষিতি বা মাটির, পুষ্প ব্যোম বা আকাশের, ধূপ মরুৎ বা বায়ুর, দীপ অগ্নির এবং নৈবেদ্য অপ বা জলের প্রতীক। দেহের উপাদান পঞ্চভূতকে দেবতার চরণে উৎসর্গ করলে পূজকের মনে দৈহিক বা বৈষায়িক চিন্তার পরিবর্তে আত্মার চিন্তা আসে। দেহ আত্মা নয় এবং আত্মাও দেহ নয় এই বোধ জাগ্রত করার মধ্যেই পূজার স্বার্থকতা।
প্রণাম
প্রণামের মাধ্যমে পূজক দেবতার নিকট নিজেকে সমর্পণ বা আত্ম-নিবেদন করেন। প্রণামের মধ্যে অষ্টাঙ্গ প্রণামই শ্রেষ্ঠ। বিষ্ণুকে নিজের বামে, মহাদেব ও শক্তিকে (দুর্গা, কালী প্রভৃতি) ডানে এবং অন্যান্য দেবতাকে বামে বা সম্মুখে রেখে প্রণাম করতে হয়।
হোম
পূজা শেষে বৈদিক হোম করা আবশ্যক। বৈদিক রীতিনীতিকে ধরে রাখার জন্য হোমকে পূজার একটি অঙ্গ হিসেবে স্থান দেয়া হয়েছে। হোম ত্রিবিধ, যথা— স্থুল, সূক্ষ্ম ও পর। স্থুল-হোম বাহ্য এবং সূক্ষ্ম ও পর হোম আন্তর। তবে প্রতীমা না থাকলে হোমের প্রয়োজন হয় না। হোম শেষে ছাই-ভস্ম ললাটে কণ্ঠে, বাহুমুলদ্বয়ে এবং হৃদয়ে ধারণ করতে হয়।
আরত্রিক
আরত্রিককে নীরাজন বা দীপাবর্তন বা আরতি বলা হয়। তবে আরতি শব্দটিই বেশি প্রচলিত। ‘আ’ অর্থ বিস্তৃতি ‘রতি’ অর্থ প্রেম বা প্রীতি। তাই দেবতার প্রীতিলাভের জন্য যে অনুষ্ঠান, তাই আরতি। দেবপূজায় যদি কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে, তা আরত্রিকের দ্বারা পূর্ণ হয়। আরত্রিকের সময় প্রদীপ, কপূর্র, দীপ, জলপূর্ণ শঙ্খ, ধৌত বস্ত্র, বিল্বপত্র, পুষ্প এবং চামর দেবতার চরণে চার বার, নাভিদেশে দুই বার, মুখমণ্ডলে তিন বার এবং সর্বাঙ্গে সাত বার ঘুরাতে হয়। ধূপ বলতে ষড়ঙ্গ ধূপ বোঝায়। চিনি, মধু, গব্যঘৃত, শ্বেত-চন্দন কাষ্ঠ, অগুরু কাষ্ঠ এবং গুগ্গুল একত্রে বেটে রোদে শুকালে ষড়ঙ্গ ধূপ তৈরি হয়। আরত্রিকে পাঁচতি সলতে যুক্ত পঞ্চ-প্রদীপ ব্যবহার করা হয়।
আরত্রিকের সময় ঘণ্টা, কাঁসর, ঢাক প্রভৃতি বাদ্য বাজাতে হয়। আরত্রিকের পশ্চাতে রয়েছে এক সূক্ষ্ম দর্শন। আরত্রিকের পঞ্চপ্রদীপ রূপের, জলপূর্ণ-শঙ্খ রসের, ধূপ ও পুষ্প গন্ধের, চামর স্পর্শের এবং ঘন্টা-ধ্বনি শব্দের প্রতীক। আরত্রিকের ছলে মূলত পঞ্চভূতের গুণ অর্থাৎ শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধকে দেবতার উদ্দেশ্যে সমর্পণ করা হয়। পঞ্চভূত দ্বারা জীবের দেহ গঠিত। তাই পঞ্চভূত সমর্পণ করার অর্থ দেবতাকে সর্বস্য দান করা। সুতরাং আরত্রিক শুধুমাত্র দৈহিক অঙ্গভঙ্গি নয়, আরত্রিক আত্ম-নিবেদনের বহিপ্রর্কাশও বটে। আরত্রিকের সময় ঢাক, কাঁসর, ঘণ্টা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের শব্দে নৃত্য করলে পূজকের কুলকুণ্ডলিনী শক্তি জেগে ওঠে এবং পূজক সকল বাহ্য-চেতনা ভূলে গিয়ে এক অনির্বচনীয় আনন্দ লাভ করেন। সাধারণত গায়ত্রী-পাঠ ও মন্ত্রজপের পরেই আরত্রিক করা হয়।
বিসর্জন
বিসর্জন অর্থ দেবতার প্রস্থান এবং মূর্তিকে জলে ভাসানো নয়। প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করে যে দেবতাকে পূজা করা হয়েছে, সে দেবতাকে হৃদয়ে স্থান দেয়াই হল বিসর্জন। প্রাণ-প্রতিষ্ঠার সময় পূজক হৃদয়ের যে দেবতাকে নিষ্প্রাণ প্রতীমায় স্থাপন করে প্রতীমাকে চৈতন্যময় করেছিলেন। বিসর্জনের সময় সেই দেবতাকেই পুনরায় হৃদয়ে স্থান দেয়া হয়। তাই বিসর্জনের পরে ঐ মৃন্মময় মূর্তি চিন্ময় হয়ে পূজকের হৃদয়ে স্থানান্তরিত হয়। ফলে ঐ বাহ্য-মূর্তি জড় পদার্থে পরিণত হয়। চৈতন্যহীন ঐ জড় মূর্তি জলে ভাসিয়ে দেয়াই শ্রেয়।
প্রদক্ষিণ
দেবতাকে নিজের দক্ষিণে রেখে প্রদক্ষিণ করতে হয়। শক্তি দেবতাকে এক বার, শিবকে অর্ধচন্দ্রবৎ (দক্ষিণদিক থেকে বায়ুকোণ পর্যন্ত গমন করে পুনরায় পিছন দিক থেকে দক্ষিণে ফিরে আসা), সূর্যকে ছয় বার এবং অন্যান্য দেবদেবীকে তিন বার প্রদক্ষিণ করতে হয়।
পূজাশেষে নির্মাল্য পূষ্প) গ্রহণ ও নৈবেদ্য ভক্ষণ করতে হয়। নৈবেদ্য ভক্ষণে অনেক পূণ্য অর্জিত হয়। নৈবেদ্যকে প্রসাদও বলা হয়। প্রসাদ অর্থ কৃপা। নৈবেদ্য ভক্ষণে দেবতার প্রসাদ বা কৃপা লাভ হয় বলে নৈবেদ্যকে প্রসাদ বলা হয়।
মুদ্রা
যা দেবতাদের প্রীতি উৎপাদন করে এবং পাপসমূহ দূর করে তাকেই মুদ্রা বলে। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট মুদ্রা প্রদর্শন করতে হয়। উভয় হাতের করতল চিৎভাবে সংযুক্ত করে দুই হাতের অনামিকার মূলপর্বে বৃদ্ধাঙ্গুলি আবদ্ধ করলে আবাহনী মুদ্রা হয়। উক্ত আবাহনী মুদ্রা উভয় হাতের করতল অধোমুখভাবে রাখলে স্থাপনী মুদ্রা হয়। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বৃদ্ধাঙ্গুলিদ্বয় উচু করে সংযুক্ত করলে সন্নিধাপনী মুদ্রা হয়। বৃদ্ধাঙ্গুলিদ্বয়কে ঐভাবে করতলের মধ্যে রেখে হাত দুইটি মুষ্টিবদ্ধ করলে সন্নিরোধনী মুদ্রা হয়। সন্নিরোধনী মুদ্রা কৃত মুষ্টিদ্বয় চিৎ করলে সম্মুখীকরণ মুদ্রা হয়।
মধ্যমাঙ্গুলি সরলভাবে প্রসারিত করে তর্জনী ইষ্যৎ বক্র করে মধ্যমার মধ্যপর্বে সংযুক্ত করে অনামিকা ও কনিষ্ঠা বক্র করে করতল স্পর্শ করলে অঙ্কুশ মুদ্রা হয়। ডানহাত অধোমুখ করে তার পিঠে বাম করতল স্থাপন করে উভয় হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি পরিচালিত করলে মৎস্য মুদ্রা হয়। উভয় হাতের অঙ্গুলিসমূহকে পরস্পরের সন্ধি মধ্যগত করে কনিষ্ঠার সাথে অনামিকা সংযুক্ত করে তর্জনীর অগ্রভাগের সাথে মধ্যমার অগ্রভাগ সংযুক্ত করলে ধেনু মুদ্রা হয়।
বামহাতের তর্জনীতে ডানহাতের কনিষ্ঠা এবং ডানহাতের তর্জনীতে বামহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি সংযুক্ত করে ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি উন্নতভাবে স্থাপন করে বামহাতের মধ্যমা, অনামিকা ও কনিষ্ঠা ডানহাতের পীঠে সংযুক্ত করে বামহাতের তর্জনী ও বৃদ্ধঙ্গুলির মধ্যভাগে ডানহাতের মধ্যমা ও অনামিকা অধোমুখে সংলগ্ন করলে কূর্ম মুদ্রা হয়।
দেব-পূজায় নিষিদ্ধ দ্রব্যঃ পুরুষ দেবতাকে রক্তবর্ণ পুষ্প, সূর্যকে ধুতুরা, মহাদেবকে শ্বেতজবা এবং উগ্র গন্ধযুক্ত পুষ্প দ্বারা সবদেবতাকেই পূজা নিষিদ্ধ। অর্কপুষ্প, ধুতুরা, বৃহতী, শ্মশানজাত বৃক্ষের পুষ্প এবং শেফালিকা (শিউলি) ভিন্ন অন্যান্য ভূপাতিত পুষ্প দ্বারা দেবদবীর পূজা নিষিদ্ধ। সূর্যকে বিল্বপত্র ও গণেশকে তুলসীপত্র নিবেদন নিষিদ্ধ।
শিব ও সূর্য-পূজায় অর্ঘে্য শঙ্খ নিষিদ্ধ। বিল্বপত্র তর্জনী ও অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা গ্রহণ করে উপুড় করে, তুলসীপত্র অনামিকা, মধ্যমা ও অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা ধরে চিৎ করে এবং পুষ্প যেভাবে বৃক্ষে উৎপন্ন হয় সেভাবে ধরে দেবতাকে নিবেদন করা উচিত এবং এর বিপরীত করা অকর্তব্য। বিল্বপত্র অধোমুখ করে দেবতাকে নিবেদন করতে হয় অর্থাৎ বিল্বপত্র চিৎ করে দেয়া নিষিদ্ধ। শ্রাদ্ধাদি কার্যে দূর্বার গর্ভ বা কোক না ফেলে প্রদান নিষিদ্ধ।
বামহস্তে পুষ্পপত্র নিয়ে দেবপূজা অনুচিত। দুর্গার নিকট বাঁশি, শিবের নিকট করতাল, ব্রহ্মার নিকট ঢক্কা (ঢাক) এবং লক্ষ্মীর নিকট ঘণ্টা বাদ্য নিষিদ্ধ। মনসা পূজায় ধূনা দেওয়া বিধিসম্মত নয়। দেবতাকে উৎসর্গকৃত পুষ্প দ্বারা পূজা, পূজা শেষ হওয়ার পূর্বে নৈবেদ্য বিতরণ, নির্মাল্যপুষ্প (দেবতাকে নিবেদিত পুষ্প) পদদলিত অথবা ডিঙ্গানো নিষিদ্ধ।
নির্মাল্য ও আশীর্বাদী পুষ্প মস্তকে ধারণ শেষে জলে বা বৃক্ষমূল নিক্ষেপ করা উচিত। পুষ্পের অভাবে পত্র, পত্রের অভাবে ফল এবং ফলের অভাবে কুশ দ্বারা দেবতা পূজা করার বিধান আছে। কুশের অভাব হলে গুল্ম এবং ওষধি দ্বারা পূজা করা যায় এবং যদি গুল্ম ও ওষধির অভাব হয়, তবে কেবল জল দ্বারাই পূজা করা বিধেয়। যদি জলেরও অভাব হয়, তবে কেবল মানসিক উপাচারে দেবতা পূজা করা কর্তব্য।
পুজো পদ্ধতি সম্পর্কে খুব বিস্তারিত তথ্য।আপনি কি আমাদের একটি জীবনধারা ভিত্তিক নিবন্ধ প্রদান করবেন?
উত্তরমুছুন