কর্মের বিচার
গীতায় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ কর্মের তাৎপর্য বোঝাতে গিয়ে বলেছেন:
— কেবল কর্মের অনুষ্ঠান না করার মাধ্যমে কর্মফল থেকে মুক্ত হওয়া যায় না, আবার কর্মত্যাগের মাধ্যমেও সিদ্ধি লাভ করা যায় না।
সমস্ত জীবই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে আসক্তি অথবা বিরক্তি অনুভব করে, কিন্তু এভাবে ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের বশীভূত হওয়া বুদ্ধিমান ব্যাক্তির পক্ষে উচিত নয়। কারণ বিষয় আসক্তি পারমার্থিক উন্নতির পথে প্রতিবন্ধক বলে মনে করা হয়।
যে ব্যক্তি পঞ্চ-কর্মেন্দ্রিয় সংযত করেও মনে মনে রূপ, রস, গন্ধ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়গুলি স্মরণ করে, সেই ব্যক্তি অবশ্যই মিথ্যাচারী এবং ভণ্ড। কর্মযোগের অনুষ্ঠান করা ব্যক্তি পূর্বোক্ত মিথ্যাচারী ভন্ড অপেক্ষা অনেক শ্রেষ্ঠ।
এটাও সত্য যে কোনো কর্মই দোষ রহিত নয়। তাই শাস্ত্রোক্ত কর্মের অনুষ্ঠান করা উচিত, কেন না যজ্ঞ আদি শাস্ত্রোক্ত কর্ম বেদ থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং বেদ অক্ষর বা পরমেশ্বর ভগবান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। অতএব সর্বব্যাপক ব্রহ্ম সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন। তাই কর্মের বিচার করে কর্ম করা কর্তব্য। তাই কর্মত্যাগ থেকে কর্মের অনুষ্ঠান শ্রেয়। কর্ম না করে কেউ দেহযাত্রাও নির্বাহ করতে পারে না।
কিভাবে কর্ম করতে হয়?
নিজের জন্য কোনো কর্ম করতে নেই। নিজের কর্মকে ইশ্বরের নিমিত্ত বলে কর্ম করতে হয়। তবেই সেটি কর্ম যোগ বলে বিবেচিত হয়।
প্রথমে ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে জ্ঞান ও বিজ্ঞান-নাশক পাপের প্রতীকরূপ এই কামকে বিনাশ করে ইশ্বরের নির্দেশিত কর্ম করছি, বা ইশ্বরের দয়ায় কর্ম করছি, এভাবে কর্ম করতে হয়।
ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বলছেন "স্থূল জড় পদার্থ থেকে ইন্দ্রিয়গুলি শ্রেয়; ইন্দ্রিয়গুলি থেকে মন শ্রেয়; মন থেকে বুদ্ধি শ্রেয়; আর তিনি (আত্মা) সেই বুদ্ধি থেকেও শ্রেয়।"
নিজেকে ওই জড় ইন্দ্রীয়, মন ও বুদ্ধির অতীত ব্রহ্ম জেনে, নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা মনকে স্থির করে এবং এভাবেই চিৎ-শক্তির দ্বারা কামরূপ দুর্জয় শত্রুকে জয় করা উচিত। কারণ, জড় ইন্দ্রীয়, মন ও বুদ্ধি মানুষে কর্মে বদ্ধ করে সুখ দুঃখে পতিত করে।
আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ থেকে মুক্ত হয়ে, সম্পূর্ণরূপে কর্মযোগী ঈশ্বরে মগ্ন হয়ে, একান্তভাবে ঈশ্বরের আশ্রিত হয়ে, পূর্বে বহু বহু কর্মযোগী ইশ্বরের পরম জ্ঞান লাভ করে পবিত্র হয়েছে- এবং এভাবেই সকলেই ঈশ্বরের অপ্রাকৃত প্রীতি লাভ করেছে।
যারা যেভাবে ভাবিত হয়ে ঈশ্বরে প্রতি আত্মসমর্পণ করে, ঈশ্বর তাদেরকে সেভাবেই পুরস্কৃত করেন। অর্থাৎ কামীকে কাম দ্বারা এবং ত্যাগীকে মোক্ষ প্রদান করেন।
এই জগতে মানুষেরা সকাম কর্মের সিদ্ধি কামনা করে এবং তাই তারা বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনা করে। সকাম কর্মের ফলে অবশ্যই মানুষ ইশ্বর দ্বারা অতি শীঘ্রই সিদ্ধি লাভ করে। কিন্তু যে বিবেকবান ব্যক্তি জানে যে। "কোন কর্মই সচ্চিদানন্দ রূপ আত্মা কে প্রভাবিত করতে পারে না এবং সেই সচ্চিদানন্দ রূপ আত্মা কোন কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা করে না। সচ্চিদানন্দ রূপ আত্মার এই তত্ত্ব যিনি জানেন, তিনিও কখনও সকাম কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হন না।
কাকে কর্ম ও কাকে অকর্ম বলে?
ভগবান শ্রী কৃষ্ণ গীতার চতুর্থ অধ্যায় ১৬ নম্বার শ্লোকে বলেছেন: কিং কর্ম কিমকর্মেতি কবয়োহপ্যত্র মোহিতাঃ ।
"কাকে কে কর্ম ও কাকে অকর্ম বলে তা স্থির করতে বিবেকী ব্যক্তিরাও মোহিত হন। কর্মকে অকর্ম এবং অকর্মকে কর্ম বলে মনে হয়। তাই কর্ম এবং অকর্মের রহস্য তিনি পরন্তপ অর্জুনকে বলেছেন।
"যিনি কর্মে অকর্ম দর্শন করেন এবং অকর্মে কর্ম দর্শন করেন, তিনিই মানুষের মধ্যে বুদ্ধিমান। সব রকম কর্মে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত।"
যিনি তাঁর কর্মফলের প্রতি দ্বেষ বা আকাঙ্ক্ষা করেন না, তাঁকেই নিত্য সন্ন্যাসী বলে ৷ নিত্য সন্ন্যাসী বিধাতার কৃপায় যা লাভ করেন, তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, যিনি সুখ-দুঃখ, রাগ-দ্বেষর মতো মায়া দ্বন্দ্বের প্রভাবিত হন না। এই প্রকার ব্যক্তি দ্বন্দ্বরহিত এবং পরম সুখে কর্মবন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করেন। কর্মত্যাগ কর্মযোগ উভয়ই মুক্তিদায়ক। অল্পজ্ঞ ব্যক্তিরাই কেবল সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগকে পৃথক পৃথক পদ্ধতি বলে প্রকাশ করে, পণ্ডিতেরা তা বলেন না।
উভয়ের মধ্যে যে-কোন একটিকে সুষ্ঠুরূপে আচরণ করলে উভয়ের ফলই লাভ হয়।
সাংখ্যযোগ হোলো আত্মার বিবরণ। ভগবান শ্রী কৃষ্ণ সাংখ্যযোগের দ্বারাই কর্মযোগকে বর্ননা করেছেন। তিনি সাংখ্য এবং কর্মযোগ কে পৃথক পদ্ধতি বলে মনে করেন না। তিনি বলেছেন:
"যিনি জানেন, সাংখ্য-যোগের দ্বারা যে গতি লাভ হয়, কর্মযোগের দ্বারাও সেই গতি প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং তাই যিনি সাংখ্যযোগ ও কর্ম-যোগকে এক বলে জানেন, তিনিই যথার্থ তত্ত্বদ্রষ্টা।" (গীতা অধ্যায় ৫ শ্লোক: ৫)
যিনি অনায়াসে যা লাভ করেন, তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, যিনি সুখ-দুঃখ, রাগ-দ্বেষর মতো মায়া দ্বন্দ্বের বশীভূত হন না এবং মাৎসর্যশূন্য, যিনি কার্যের সাফল্য ও অসাফল্যে অবিচলিত থাকেন, তিনি কর্ম সম্পাদন করলেও কর্মফলের দ্বারা কখনও আবদ্ধ হন না। অর্থাৎ যিনি কর্মফলের আসক্তি সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে সর্বদা তৃপ্ত এবং কোন রকম আশা আকাঙ্ক্ষা করেন না, তিনি সব রকম কর্মে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও কর্মফলের আশায় কোন কিছুই করেন না।
কারণ তিনি জানেন এই কর্ম আসলে ঈশ্বরই করছেন। এমন ব্যক্তি কখনো পাপ কার্যে লিপ্ত হন না। কারণ, সে আশা বা আকাঙ্ক্ষা রহিত হয়ে অনায়াসে যা লাভ করেন সেই কর্মই পালন করেন।
প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে পরমেশ্বর ভগবান মানব-সমাজকে সৃষ্টি করেছেন। সত্তিক, রাজসিক ও তামসিক প্রকৃতির তিনটি গুণ এবং সকাম এবং নিষ্কাম কর্ম এই দুইটি কর্মের সংমিশ্রণ দ্বারা তিনি চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছেন।এই অনায়াসে যা লাভ করা বর্ণের নির্দিষ্ট কর্ম ঈশ্বরের সেবা মনে করে সাংখ্যযোগ বা কর্মযোগী যে কর্মই করেন না কেন, সে কর্মফলের দ্বারা কখনও আবদ্ধ হন না।
ব্রাহ্মণ প্রয়োজন পড়লে শাস্ত্র বিহিত ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, কিংবা শূদ্রের কর্মও করতে পারে। তাতে ব্রাহ্মণের সন্মান ক্ষয় হবে না। তাঁর কোনো জাত যাবে না। তবে ওই কর্মে আসক্তি হলে ব্রাহ্মণের পতন হতে পারে। এই কর্মফলের প্রতি আসক্তিই ত্যাগই কর্ম যোগের তো মূল বিষয়।
অনুবাদঃ ঈশ্বরের চেতনায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ফলে তখন আর জড় জগতের ত্রিতাপ দুঃখ থাকে না ; এভাবে প্রসন্নতা লাভ করার ফলে বুদ্ধি শীঘ্রই স্থির হয়।
অন্ধকারে মোহাচ্ছন্ন জীব জড়া প্রকৃতির ত্রিগুণ দ্বারা ক্রিয়মাণ সমস্ত কার্যকে স্বীয় কার্য বলে মনে করে 'আমি কর্তা'- এই রকম অভিমান করে
গীতায় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বলছেন কর্ম করে যাও, ফলের চিন্তা করবে না। কর্মফলের চিন্তা না করলে কর্মের জন্য প্রেরণা কোথা থেকে আসবে?
উত্তরমুছুনএরকম কথা ভগবান কখনোই বিলেননি। তিনি যে নিষ্কাম কর্ম করতে বলেছেন, সেটি আমিত্ব ভাব শূন্য হয়ে কর্ম করার কথা বলছেন। কর্মের ফল নিয়ে চিন্তিত হলে কর্ম সফল হবে না। আর ফল যে আপনার মন মতোই হবে,এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই কর্মেই আমাদের অধিকার, এই কথা বলেছেন।
মুছুনআশাকরি আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে পেরেছি।