জ্ঞান কথার অর্থ হলো জানা। জ্ঞান যোগ হল একটি আধ্যাত্মিক সাধনার পথ যা ঈশ্বর কে নিজের ও সকলের মধ্যে একত্বের প্রয়াস পায়।
এই যোগ দ্বারা "আমি কে, আমি কী" এর মতো প্রশ্নগুলির জানার চেষ্টা করে। এই ব্লগের ভগবত গীতার জ্ঞান যোগ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আজকের আলোচনার বিষয় সূচি নিম্নে দেওয়া হলো:
জ্ঞান বিচার
আমাদের practical experience হাওয়া একটি জ্ঞান। আপনি পাহাড়ে ঘুরছেন, সেখানে পরিবেশ অপনার ভালো লাগলো। আবার, একই ভাবে অপনার সঙ্গী ওই একই যায়গায় অন্যরকম অভিজ্ঞতা পেতে পারে। তাই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যে জ্ঞান হয় সেটি সত্য নয়।
বই পড়ে আমরা যে information collect করি সেগুলোকে জ্ঞান বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। একটা বইকে পেজ নম্বর, অধ্যায় ও মন্ত্র সংখ্যা মনে করে যে ব্যক্তি উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। সে স্মৃতিধর, জ্ঞানী নন।
ধর্ম শাস্ত্র বা স্বয়ং ভগবান বলেছেন বলেই সেটা মানতে হবে। সেটাই জ্ঞান, এমন কোথাও বলা নেই। হ্যা, সেটা আপনি বিশ্বাস করে এগোতে পারেন। আপনি যতদূর জানবেন, সেখানেই আপনার জ্ঞান হবে। এর পরেও যা অপনার অজানা, সেটাও জ্ঞান। তাই এই সব রকমের জ্ঞান হলো সীমিত।
আসল জ্ঞান যা জানলে আর কিছুই জানার বাকি থাকে না তা হলো নিজেকে জানা। আমি কে? এই জগত কিভাবে এসেছে? কোনো স্রষ্টা আছে না এমনি এমনিই সব কিছু হয়েছে। এই জিজ্ঞাসাই আসল জ্ঞান।
আমি কে ?
এই পোশাক, যেটি আমি পরিধান করে আছি, সেটি আমার। অর্থাৎ আমি পোশাক নই। পোশাক আমার পরিচয় নয়। যেই দেহ এই পোশাক পড়ে আছে, সেটিও আমি নই। কারণ আমরা বলি দেহটা আমার। এই ভবে, মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার ইত্যাদির ওপর আমিত্ব আরোপিত হয়। তাই, এগুলো আমি নই। আমি কে? শাস্ত্র বলছে, আমি হলাম 'দ্রষ্টা'। দ্রষ্টা নিজেকে আহম, আত্মা এবং জগতকে ইদম, অনাত্মা বলে জানেন।
ব্রহ্মজ্ঞান
ব্রহ্ম জ্ঞানী আরো এক ধাপ এগিয়ে সকলের মধ্যে আমি আছি, আমিই সত্য, জগতে মিথ্যা —এই বিচার করে। কিভাবে?
একই মাটিতে উৎপন্ন দুটি নারকেল গাছে যে ভিন্ন ভিন্ন নারকেল হয়। তাদের মধ্যে যে জল থাকে, সেই জল ওই একই মাটির। এভাবে পৃথিবীতে সব নারকেল গাছে যে যে ডাব বা নারকেল হয়। তার মধ্যে যে জল থাকে, সেই সবেতেই এই পৃথিবীর ভৌম জলই থাকে। স্থান ও প্রকৃতির কারণে তাঁদের নাম ও স্বাদ আলাদা আলাদা হয়।
এবার এই পৃথিবীতে যে জল সেটাও অন্তরীক্ষের অন্যান গ্রহের জলের থেকে আলাদা নয়। সালফার, ক্লোরিন, প্রভৃতি যৌগ মিশ্রিত হয়ে ওই জল থেকেই সালফার ডাই অক্সাইড, ক্লোরাইড অক্সাইট জাতীয় যৌগ উৎপন্ন হয়েছে। মোট কথা, আমি আপনি আমরা সকলেই এই মহাবিশ্বের অংশ।
এই বিশ্ব কোথা থেকে এলো? আমরা বলি ঈশ্বর মায়া আশ্রয়ে জগত হয়েছেন।অর্থাৎ জগৎ মায়াময়*। মায়া পতি ইশ্বর সত্য জগত মিথ্যা।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সরল ভাষায়;
একই ব্রাহ্মণ। যখন পূজা করে, তার নাম পূজারী; যখন রাঁধে তখন রাঁধুনী বামুন। যে জ্ঞানী, জ্ঞানযোগ ধরে আছে, সে নেতি নেতি — এই বিচার করে। ব্রহ্ম এ নয়, ও নয়; জীব নয়, জগৎ নয়। বিচার করতে করতে যখন মন স্থির হয়, মনের লয় হয়, সমাধি হয়, তখন ব্রহ্মজ্ঞান হয়।
ব্রহ্মজ্ঞানীকে নাস্তিক দর্শন বৌদ্ধ ধর্মে নির্বাণ বলা হয়েছে। নির্বাণ লাভ করে মানুষ নিজেই বুদ্ধ হয়। তাই বুদ্ধ কোনো ব্যক্তি নয়। বুদ্ধরা একেই পুনর্জন্ম বলে। খ্রীষ্টের পুনরুত্থানও বুদ্ধ মতের প্রতিফলন।
গীতার দর্শন
যখনভগবান শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন আমি এই জ্ঞান বিবস্বান মনুকে বলেছিলাম, সেই জ্ঞান পরম্পরায় লুপ্ত হয়ে গেছে। তখন অর্জুন শ্রী কৃষ্ণকে বললেন, "বিবস্বাণ অপনার অনেক আগে জন্মেছে।" শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন:
"যদিও আমি জন্মরহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভূতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।"
অনুবাদ: হে ভরত পৌত্র! যখন যখন ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকট করে অবতীর্ণ হই।
অনুবাদ: কোন কর্মই আমাকে প্রভাবিত করতে পারে না এবং আমিও কোন কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা করি না। আমার এই তত্ত্ব যিনি জানেন, তিনিও কখনও সকাম কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হন না।
ঈশ্বর কেন বলেছেন, তাঁর কর্ম এই তত্ত্ব যিনি জানেন, তিনিও কখনও সকাম কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হন না? কারণ তিনি যে কর্ম করেন সেই কর্ম ফলের স্পৃহা করেন না।
অনুবাদ: ব্রহ্ম অর্পিত ব্রহ্ম হবি ব্রহ্ম অগ্নিতে আহুত হয়ে ব্রহ্ম কর্ম সম্পন্ন হয়। ব্রহ্মের উদ্দেশ্যে এই কর্ম ব্রহ্ম প্রাপ্ত হন।
যিনি ঈশ্বরের ভাবনায় মগ্ন হয়ে তার সকল কর্মকে ঈশ্বরের কর্ম, মনে করে কর্ম করেন। তিনি অবশ্যই ইশ্বরকে তৃপ করেন। তাঁর কর্মের উদ্দেশ্য ঈশ্বরময় এবং সেই উদ্দেশ্যে তিনি যা নিবেদন করেন, তাও ইশ্বরের। কারণ তিনি যে কর্ম করেন সেই কর্ম ফলের স্পৃহা করেন না।
বৈষ্ণব ভক্তরা শ্রী বিষ্ণুর অবতার শ্রী কৃষ্ণের ভাবনায় এই জ্ঞান ধারণ করবেন। অন্য ইশ্বরপন্থীরা ইহাকে তাঁর নিজ নিজ ইষ্ট বাণী মনে করবেন। তাহলেই দ্বন্দ্ব থাকবে না।
কিভাবে বুঝবেন আপনি ব্রহ্ম?
কোনও কোনও যোগী দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করার মাধ্যমে তাঁদের উপাসনা করেন, আর অন্য অনেকে ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে সব কিছু নিবেদন করার মাধ্যমে যজ্ঞ করেন।
এঁরা সকলেই যজ্ঞতত্ত্ববিৎ এবং যজ্ঞের প্রভাবে পাপ থেকে মুক্ত হয়। তাঁরা যজ্ঞাবশিষ্ট অমৃত আস্বাদন করেন, এবং তার পর সনাতন ব্রহ্মে ফিরে যান।
সাংখ তত্ত্বে বিচার
এমন কোন সময় ছিল না যখন আমি, তুমি ও এই সমস্ত আত্মীয় স্বজন ছিলেন না এবং ভবিষ্যতেও কখনও আমাদের অস্তিত্ব বিনষ্ট হবে না । দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী ( আত্মা ) এক দেহ থেকে অন্য কোন দেহে দেহান্তরিত হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা কখনও এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না।
আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না৷ তিনি জন্মরহিত শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না।
এই জ্ঞান যিনি নিজে উপলদ্ধি করতে পারেন তিনিই প্রকৃত জ্ঞানী।
Very informative. Add Internal and External link for more Authentic and reachability.
উত্তরমুছুন