স্রষ্টা ব্রহ্মার অজাচার: বৃহদারণ্যক উপনিষদে
অজাচার (Incest):
অজাচার হলো ঘনিষ্ঠ রক্তীয় সম্পর্ক আছে এমন আত্মীয়ের সঙ্গে যৌনকর্ম বা যৌনসঙ্গম। অজাচার মূলত তিনটি যৌনসম্পর্কে ইঙ্গিত করে; যথা:-
- কন্যা ও পিতার যৌন সম্পর্ক,
- পুত্র ও মাতার যৌন সম্পর্ক, এবং
- বোনের সঙ্গে ভাইয়ের যৌনকর্ম বা যৌনসঙ্গম।
আরোপ:
নাস্তিকদের সংশয় ডট কম ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হিন্দু ধর্মের স্রষ্টা ব্রহ্মার অজাচার সম্পর্কিত একটি সমালোচনায় তারা আরোপ করেছেন যে, বৃহদারণ্যক উপনিষদে প্রজাপতি তার শরীর হতে এক নারীকে উৎপন্ন করে তার সাথে মিলনের মাধ্যমে সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন করেছিলেন। এই আরোপকে সমর্থন করার জন্য তারা নিম্ন লিখিত উদ্ধৃতি গুলো প্রকাশ করেছেন।
“(কিন্তু) তিনি আনন্দ পাইলেন না; সেইজন্য কেহ একা থাকিয়া আনন্দ পায় না। তিনি দ্বিতীয় (সঙ্গী লাভ করিতে) চাহিলেন। স্ত্রী ও পুরুষ আলিঙ্গিত হইলে যে পরিমাণ হয়, তিনি ততখানিই ছিলেন। তিনি নিজের দেহকে দুইভাগে ভাগ করিলেন। এইভাবে পতি ও পত্নী হইল। এই জন্য যাজ্ঞবল্ক্য বলিয়াছেন- ‘প্রত্যেকে নিজে অর্ধবিদলের মত’ ; এই জন্য শূন্য স্থান স্ত্রী দ্বারা পূর্ণ হয়। তিনি সেই পত্নীতে মিথুনভাবে উপগত হইয়াছিলেন। তাহার ফলে মানুষের উৎপত্তি হইল।“(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১/৪/৩ | হরফ প্রকাশনী)
“সেই স্ত্রী এইপ্রকার চিন্তা করিল- ‘আমাকে আপনা হইতে উৎপন্ন করিয়া ইনি কিভাবে আমাতে উপগত হইতেছেন? আমি অদৃশ্য হই।‘ সে গাভী হইল; অন্যজন (প্রজাপতি) বৃষ হইয়া তাহাতেই উপগত হইলেন; এইরূপে গরু উৎপন্ন হইল। একজন অশ্বা হইল, অপরজন অশ্ব হইলেন; একজন গর্দভী, অপরজন গর্দভ হইলেন। তিনি তাহাতে উপগত হইলেন। একজন অজা, অন্যজন অজ হইলেন। এইরূপে ছাগ ও মেষ উৎপন্ন হইল। পিপীলিকা পর্যন্ত যতপ্রকার মিথুন আছে, সেই সবই তিনি এইভাবে সৃষ্টি করিয়াছেন।“ (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১/৪/৪| হরফ প্রকাশনী )
উক্ত উদ্ধৃতি গুলোর সত্যতা এবং বাস্তবতা নিয়ে আমাদের আজকের এই আলোচনা। প্রথমে আমরা উদ্ধৃতি গুলোকে প্রকৃত বৃহদারণ্যক উপনিষদের ব্যখ্যা দ্বারা পরখ করে দেখবো এবং এই উক্তিটির প্রাসঙ্গিক মূল ভাবকে বিশ্লেষণ করবো।
প্রকৃত বৃহদারণ্যক উপনিষদের ব্যখ্যা:
উপনিষদ হিন্দু সনাতন বৈদিক সংস্কৃতির এক অমূল্য শাস্ত্র। উপনিষদকে বেদান্ত বলা হয়। কারণ , বেদের শুদ্ধতম নির্যাস বা দর্শন হলো এই উপনিষদ। বেদের শ্রেষ্ঠ এই জ্ঞানই হোলো অন্তিম জ্ঞান । উপনিষদ কোনো কামশাস্ত্র বা যৌনশাস্ত্র নয়। বরং মানব জীবকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা, মাৎসর্য থেকে তুলে ব্রহ্মবোধ দ্বারা উন্নীত করে জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্তি প্রদান করাই মূলত এই শাস্ত্রের উদ্দেশ্য। তাহলে এই উপনিষদে অজাচারের মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কেনই বা প্রশ্ন উঠবে?
উপনিষদ বলে ব্রহ্মকে সাধারণ ধ্যান-ধারণা বা ব্যাখ্যা দ্বারা ব্যাক্ত করা সম্ভব নয় কেবলমাত্র তাঁকে জেনেই জানা যায়। যেভাবে জন্মগত অন্ধকে লাল-সাদা-কালো রঙের বর্ননা দ্বারা এই রঙ গুলোর মধ্যেকার বিভেদের ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। অন্ধকে চক্ষু প্রদান করেই রঙের বিবরণ দেওয়া সম্ভব। সেই ভাবেই ব্রহ্মকে জেনেই জানা সম্ভব। উপনিষদ আরোও বলে, এই আত্মাই সেই ব্রহ্ম। কিন্তু মায়ার ভেদ জ্ঞানের কারণে এই আত্মা, সেই আত্মা কিংবা পরমাত্মা (ব্রহ্ম)-কে আলাদা আলাদা মনে হয়। কেবল মাত্র ব্ৰহ্মই আছে।
উপনিষদের তিনটি ভাগ আছে। এদের কান্ড বলা হয়। ইহারা যথাক্রমে : ১.মধু কান্ড , ২.মুনি কান্ড ও ৩. খিলা কান্ড। প্রতিটি কান্ডর দুটি করে অধ্যায় আছে এবং ক্রমশ ১২, ১৫ এবং ২০টি ব্রাহ্মণ দ্বারা বিভক্ত। প্রথম ৬টি কাণ্ড মধু কাণ্ড, পরবর্তী ৬ টি কাণ্ড মুনি কাণ্ড এবং শেষ ৬ টি কাণ্ড খিলা কাণ্ড।
- ১. মধু কান্ড: এর মুখ্য বিষয় হলো অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব (ইহা বিশ্বের স্বরূপ প্রকাশ করে)। বিশ্বের উৎপত্তি , প্রাণের ক্রিয়া ইত্যাদি ।
- ২. মুনি কান্ড: এর মুখ্য বিষয় হলো রাজা জনকের সভায় মুনিদের ব্রহ্মতত্ব এবং শাস্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উত্তর সংক্রান্ত আলোচনা।
- ৩. খিলা কান্ড: এর মুখ্য বিষয় হলো ব্রহ্মের অখন্ডতা, গো মাতার মহত্ব , গায়েত্রীর মন্ত্রের মহত্ব ইত্যাদি বিষয়ে এই কান্ডে আলোচনা করা হয়েছে।
ওঁ स वै नैव रेमे तस्मादेकाकी न रमते । स द्वितीयमैच्छत् स हैतावानास यथा स्त्रीपुमासौ सम्परिष्वक्तौ । स इममेवाऽऽत्मानं द्वेधाऽपातयत्। ततः पतिश्च पत्नी चाभवताम् । तस्मादिदमर्धबृगलमिव स्व इति ह स्माऽऽह याज्ञवल्क्यस् तस्मादयमाकाशः स्त्रिया पूर्यत एव । ता समभवत् ततो मनुष्या अजायन्त ॥ ३ ॥
Translation:
He was not at all happy. Therefore people (still) are not happy when alone. He desired a mate. He became as big as man and wife embracing each other. He parted this very body into two. From that came husband and wife. Therefore, said Yajnavalkya, this (body) is one-half of oneself, like one of the two halves of a split pea. Therefore this space is indeed filled by the wife. He was united with her. From that men were born.
স্পষ্টতই, এর থেকে আরোপ খণ্ডিত হয়ে যায় "From that came husband and wife" অর্থাৎ সেখান থেকেই স্বামী স্ত্রীর উৎপত্তি হলো। তাই হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র গুলো পিতা বা কন্যার যৌন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করছে না। একই শরীর থেকে দুটি রূপ ধারণ করে সেই পরম পুরুষ স্বামী স্ত্রী রূপেই মিলিত হয়েছেন। এই কথাই বলা হয়েছে।
প্রাসঙ্গিক মূল ভাবের বিশ্লেষণ:
ওপরে উক্ত বিষয়টি ইতিমধ্যেই নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, অজাচার দ্বারা প্রজাপতি জগৎ সৃষ্টি করেননি। বরং নিজের অংশ কেই স্ত্রী রূপে প্রকট করে তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এই সেই একই ব্রহ্ম বহু হওয়ার ইচ্ছায় এই দ্বৈত স্বত্ত্ব রূপে প্রকটিত হয়েছে। উক্ত এই অদ্বৈত থেকে দ্বৈত চেতনাকে উপনিষদ অজ্ঞানতা, মায়া রূপে ব্যখ্যা করেছে। মূলত ব্রহ্ম একই, কিন্তু এই অজ্ঞানতার কারণে সে নিজেকে 'আমি' এই রূপে চেনে। সমগ্র বৃহদারণ্যক উপনিষদ পাঠ করলে সেটাই বরং বার ফুটে আসে। ব্রহ্মের কাছে স্ত্রী, পুরুষ মানুষ পশুর ভেদাভেদ নেই। সকলেই ব্রহ্মের অভিব্যক্তি।
উপসংহার:
যারা এরকম মিথ্যা রটনা রটিয়ে হিন্দু ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে থাকে, তাদের মনে হিন্দু ধর্মের প্রতি প্রচন্ড রকমের ঘৃণা রয়েছে। অথবা বলা যেতে পারে, তারা নিজেদের অজ্ঞতার এমন স্তরে নামিয়ে ফেলেছে যে সত্যকে বিবেচনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। অবশ্য তার নিজের আরোপিত তথ্যও উল্লেখ করেছেন, "তিনি নিজের দেহকে দুইভাগে ভাগ করিলেন। এইভাবে পতি ও পত্নী হইল।" অথচ তার দ্বারাও সে হিন্দু সৃষ্টি কর্তার অজাচার কেই প্রমাণ করতে চাইছেন। এ হেন ব্যাক্তির জন্য দয়া হয়।
ঈশ্বর এমন ব্যক্তিকে সদবুদ্ধি প্রদান করুক, এই প্রার্থনা করি। নীচে তথ্য সূত্রে বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি pdf বইয়ের লিংক দেওয়া হয়েছে। দেখতে পারেন।
0 Comments: