বেদে ঈশ্বরকে নিরাকার বলা হয়েছে। তা সত্ত্বেও মূর্তিপূজা কেন করা হয়?
বেদে ঈশ্বরকে নিরাকার বলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাঁকে শুধুমাত্র নিরাকার বলেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয় নাই। বেদে ঈশ্বরকে সাকার এবং নিরাকার উভয়ই বলা হয়েছে। নিরাকার কথার অর্থ হলো আকারহীন। এই নিরাকারের উদাহরণ হিসেবে বায়ুকে দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব তুলনা করা হয়। কিন্তু এটাও সঠিকভাবে নিরাকারের ব্যাখ্যা নয়। কারণ বায়ু দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু সেটার নির্দিষ্ট আকার আছে। বেলুনে ভরে রাখলে বেলুনের আকার ধারণ করে। আবার অনেকে নিরাকারকে ব্যথা, প্রেম বা অনুভূতি দ্বারা বর্ণনার চেষ্টা করে। এটাও সঠিক উদাহরণ নয়। এগুলোরও নির্দিষ্ট পরিমাপ আছে। পরিমাপ যোগ্য যে কোনো বিষয় সাকার। নিরাকার শব্দের অর্থ হলো অসীম।
অসীমের সঙ্গে কোনো কিছু যোগ বিয়োগ গুন ভাগ করলে ফলাফল অসীমই থাকে। সেইরকমই ঈশ্বরের নিরাকার স্বরূপ।
সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ। স ভূমিং বিশ্বতো বৃত্বাত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্।। (ঋগ্বেদ-১০/৯০/১)
বিশ্লেষণ: এই সহস্র মস্তক, চোখ এবং পায়ের রহস্য হলো তিনি সর্বজ্ঞ, সর্ব দ্রষ্টা এবং সর্বব্যাপী। এই ব্যাপকতার দ্বারা তিনি সমগ্র জগৎকে আবৃত করে আছেন এবং জগতের মধ্যেও সূক্ষ্ম রূপে বিরাজমান আছেন। তাঁর সেই আবৃত রূপকে নিরাকার বলা হয়, আর সূক্ষ্ম রূপকে সাকার বলা হয়। সুক্ষ সাকার রূপের নাম ব্রহ্ম (যোগীগন একে আত্মা বলে জানেন) এবং বিরাট রূপের নাম পরব্রহ্ম (যোগী গন একই পরমাত্মা বলে জানেন।)।
আত্মা পরমাত্মার অখন্ড অংশ, জগৎ আত্মার চেতনার প্রকট। চেতনা ঘনীভূত হয়ে মন, বুদ্ধি, এবং ইন্দ্রিয়ের রূপ ধারণ করেছে। এগুলো পরস্পরে সংস্পর্শে এসে রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ স্পর্শের দ্বারা দেহ গঠন করেছে। কীটনু থেকে দেবতা পর্যন্ত সমস্ত চেতনার স্তরে এক এবং অদ্বিতীয় পরম চেতনার আধিপত্য। সে এই সব কিছুর কারণ হয়েও নিজে প্রভাবিত নয়। ―এটাই সাকার ও নিরাকারের তুনলা।
পূজা সর্বদা সাকারেরই সম্ভব। নিরাকারের পূজা সম্ভব হয় না। নিরাকারের উপাসনা করা হয়। হিন্দু সাকারের পূজার মাধ্যমে নিরাকারের উপাসনা করে। পূজার ব্যবস্থা অনন্য ধর্মে নেই। তার কেবলমাত্র উপাসনা করে।
পূজা আর উপাসনা দুটি আলাদা আলাদা বিষয়। পূজায় বিভিন্ন উপাচার দরকার হয়। উপাসনায় মন আর ইষ্ঠ হলেই হয়। যেমন ধরুন বৈদ্যুতিক আলো, পাখা, ফ্রিজ, হিটার ব্যবহার করতে বিদ্যুৎ দরকার হয়। বিদ্যুৎ থেকে সরাসরি আলো, হওয়া, শীতলতা, উষ্ণতা পাওয়া যায় না। আবার সুইচ না দাবালে এই সকল যন্ত্র চালু হয় না। পূজা উপাচার সেরকমই। ওই এক বিদ্যুৎ সবেতেই আছে। শুধু পাত্র ভেদে পাত্রতার ভেদ। এখন প্রশ্ন হলো, যদি উপাসনা করেই ঈশ্বর প্রাপ্তি সম্ভব হয়, তবে পূজার প্রয়জন কি?
পড়াশোনা করে বিদ্যান হওয়া যায়, শ্রম করলে অর্থ উপার্জন করা যায়। কিন্তু এই ধনবান, বা বিদ্যান ব্যক্তি যদি বিনয়ী না হয়। তাঁর ধন আর বিদ্যার কোনো মূল্য থাকে না। আধ্যাত্মিক উন্নতি তো দূরে থাক। সামাজিক সদ্ভাবও তার মধ্যে দেখা যায় না। তাই, হিন্দুরা গো, নদী, পাহাড়, পর্বত, পিতা মাতা, অতিথিদের দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। খৃস্টানরা তাদের বিভিন্ন সেন্ট এবং পবিত্র আত্মাকে ধন্যবাদ জানায় এসবই পূজা। মুসলমানরা হজরত মহম্মদকে মহব্বত করে, তাঁর বিনিময়ে আল্লাহর নিকট সোয়াব হাসিল করে। এসবই ঈশ্বরের উপাসনা।
তাই সবাই কোনো না কোনো ভাবে পূজা করে। এই পূজার মাধ্যমে এক এবং অভিন্ন, অবিনশ্বর পরমাত্মার উপাসনা হয়।
ইসলামে সাকার আল্লাহর প্রমাণ:
মুসলিম ধর্মগ্রন্থ কুরআনের সূরা আল হাদীদের তিন নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে।
ہُوَ الۡاَوَّلُ وَالۡاٰخِرُ وَالظَّاہِرُ وَالۡبَاطِنُ ۚ وَہُوَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ
অর্থ: তিনি আদি, তিনি অন্ত এবং তিনি ব্যক্ত ও তিনি গুপ্ত। তিনি সব সম্পূর্ণরূপে জানেন।
তিনি গুপ্ত এবং ব্যক্ত। তিনি গুপ্ত কারণ, কেউই তাঁর রূপ দেখেনি। একেবারে আখেরাতের দিন তিনি প্রকট হবেন। তিনি ব্যক্ত তাঁর এই জগতের মহিমা দ্বারা। ইসলামের ধর্ম পুস্তক কোরআনের দ্বিতীয় সূরার 255 তম আয়াতে আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে।
আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্বচরাচরের ধারক। তাঁর কোনো তন্দ্রা বা নিদ্রা নেই। আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবকিছু তারই অন্তর্গত। তাঁর হুকুম ব্যতিত এমন কে আছে যে, তাঁর নিকটে সুফারিশ করতে পারে? তাদের সম্মুখে ও পিছনে যা কিছু আছে সবকিছুই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানসমুদ্র হতে তারা কিছুই আয়ত্ত করতে পারে না, কেবল যতুটুকু তিনি দিতে ইচ্ছা করেন তা ব্যতিত। তাঁর কুরসি সমগ্র আসমান ও জমিন আবৃত করে আছে। আর সেগুলোর তত্ত্বাবধান তাঁকে মোটেই শ্রান্ত করে না। তিনি সর্বোচ্চ ও মহান’।
সনাতনী দৃষ্টিতে এর সমালোচনা: (আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই।) এর অর্থ হলো, যে যেভাবেই তাঁর উপাসনা করেন, সর্বত ভাবে তাঁরই উপাসনা করা হয়। দ্বিতীয় কেউ থাকলে হয়তো উপাসনা সম্ভব হতো। কিন্তু মুসলমানরা আল্লাহ এই নামকেই Promote করে। কারণ, তাদের কাছে ইসলাম বিস্তার করা জীবনের লক্ষ্য। এরপর বলা হয়েছে "যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্বচরাচরের ধারক।") অর্থাৎ তিনি শাশ্বত এবং তিনি বিশ্ব চরাচরকে ধারণ করে আছেন। (তাঁর কোনো তন্দ্রা বা নিদ্রা নেই।) এই নিদ্রা কি মানুষের নিদ্রা? না তিনি সাধারণ মানুষের মতো মোহ নিদ্রায় আবিষ্ট হনন না, কারণ তিনি অক্লান্ত, জগতের চেতনা রূপে তিনি সদা জাগ্রত থাকেন। তিনিই জগতে ব্যাপ্ত হয়ে আসমান ও জমিনের কোণায় কোণায় বিদ্যমান। আমাদের জ্ঞাত অজ্ঞাত সকল বিষয়ের তত্ত্বাবধান করেন। তার ইচ্ছা ছাড়া কেউ তাঁর বিরুদ্ধে বা পক্ষে কোনো কাজ করতে পারে না। তাঁর ভক্তি বা উপাসনার জন্যও তাঁর অনুগ্রহ দরকার হয়।
0 Comments: