জাতিভেদ কি ব্রাহ্মণ্যবাদ?
বিতর্ক সব কিছু নিয়েই আছে। কোনো কিছু 100% বিতর্কহীন নয়। তবে, জাতি ভেদ নিয়ে থাকবে না কেন? এই ভেদাভেদের ভেদ (রহস্য) বুঝতে গেলে শাস্ত্র বুঝতে হবে। কিন্তু শাস্ত্র গুরুগম্য বিদ্যা হওয়ায়, শাস্ত্র যে কেউ পড়ে কেউ তাঁর একটি অর্থও বুঝতে পারবে না। গুরু যদি যথার্থ বলে দেয়, তবেই বোঝা সম্ভব। হনুমান সূর্য গিলে ফেললো, চন্দ্র শিবের ললাটে থাকে, শিব বিষ পান করলো। এসব যথাযথ অর্থ প্রকাশ করে না। এদের অর্থ ঠিক তেমন নয়, যেমনটি বলা হয়েছে। সূর্য নাড়ি ‘পিঙ্গল’ সেই নাড়িতে যে স্বাস প্রবাহ হয়, সেটা গিলেছিল হনুমান। ফলে ইন্দ্রের প্রহার সহ্য করতে হয়েছে। শিবের ললাটে চাঁদ নেই। বরং চাঁদের মতো উজ্জ্বল তাঁর ললাট। শিব বিষ পান করেছেন ঠিকই। কিন্তু সেই বিষ সংসারের অসারতার বিষ। যেটা তিনি সম্পূর্ণ না গিলে গলায় ধারণ করেছেন। অর্থাৎ নিজেকে নির্লিপ্ত রেখেছেন। তাই গুরুর নিকট এসব অর্থ বুজতে হবে। তবেই সংশয় মুক্ত হবে। তাই যুক্তিবাদীদের সব উক্তি গ্রহণ করার আগে তাদের মতলব বুঝতে হবে। তারা কি বলছে, তার থেকেও বড় কথা হলো কেন বলছে। তাদের যতই যুক্তি, তর্ক প্রমান দেখানো হোক। তারা নিজের উদেশ্য স্থির রেখেই অপবাদ চালায়। তাই আমাদেরও উচিত নিজের তর্ক প্রমান সবল রেখে তাদের এড়িয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলা।
বর্নবাদের ওপর হিন্দুদের একটি কালো ইতিহাস ছিলো। এটা মানতে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু, সেই ইতিহাস কি সত্যিই কালো ছিলো? ধূসর বা শ্বেত-ধূসরও হতে পারতো। তাই না?? কে জানে, সেটা? যেহেতু আমাদের সর্বদা ব্রহ্মণদের শূদ্রের শত্রু রূপে দেখানো হয়েছে এবং শূদ্রকে সর্বদা নিরীহ, দুর্বল, গো-বেচারা, দেখানো হয়। ফলে স্বভাবতই ব্রাহ্মণদের প্রতি আমাদের মনে একটা ঘৃণার ভাব এসে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু ধর্মের প্রতি, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি, ভারতীয় দর্শনের প্রতিও হেয় ভাব এসে যায়। অথচ আমরা জানি, এই দেশের ইতিহাস এতটা হেয় নয়, যতটা বইয়ে পড়ানো হয়। তেমনটি হলে আমার বোনের অন্নপ্রাসন অনুষ্ঠানে, দিদার শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানে, কাকুর দাদার বিবাহ অনুষ্ঠানে নাপিতের কোনো গুরুত্ব থাকতো না। ব্রাহ্মণের বেদ মন্ত্রোচারণ দ্বারাই শুদ্ধি কর্ম সম্পন্ন হতো। 1000 বছরের দাসত্ব আমাদের যা শিখিয়েছে, যা বুঝিয়েছে। সেটাই আমাদের মগজে গেঁথে গেছে। সেই জন্য আমরা নিজেদেরই মহান সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে লজ্জা পাই। আসুন দেখে নেওয়া যাক, আসল সত্যটি কি।
এই বর্নবাদের উৎস কোথায়?
‘বর্ন’ এবং ‘জাতি’ -কথাটির অর্থ আগে বুঝতে হবে। তারপর উৎসের সন্ধানে যাওয়া যাবে। বর্নকে Institutional individualism বলে যেতে পারে অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি স্বতন্ত্রতা। জাতি হলো কোনো বিশেষ প্রকার জনগোষ্ঠী যারা বর্নশংকর জনিত কারণে সাংস্কৃতি এবং আচার আচরণ গত দিক থেকে আলাদা হয়েছে। তাই তাদের জীবিকা আলাদা আলাদা ছিলো। সূত, অমবষ্ট, বৈদেহী, মাগধ, নিষাদ, আয়োগব, ধিন্বণত্, বেণ, ধীবর, মৈত্র, মল্ল, ঝল্ল্, নট, করণ, খস, ব্রাত্য, পক্কাস, মৃগবধজীবী, চন্ডাল, মৈত্রেয় ইত্যাদি ইত্যাদি জাতি ভিন্ন ভিন্ন জীবিকা নির্বাহ করতো। যেমন সুত জাতি রথ বা অশ্বারোহন করতো, নীষাদ জাতি মৎস্য শিকার, মাগধরা বানিজ্য করতো। অর্থাৎ এই জাতিগুল মিলেই বর্ন সৃষ্টি হয়েছে, এবং বর্ন গুলোর বৈবাহিক সম্পর্কের দ্বারা জাতি গুলো জন্ম নিয়েছে।
মনু সংহিতায় সব থেকে অবহেলিত জাতি হলো ‘চন্ডাল’ এবং ‘শ্বপচ’ এরা ভবঘুরে। এদের নিবাস শহর এবং গ্রামের বাইরে। এরা শূদ্রদের থেকেও নিচু। এরকম বলা হয়েছে। ‘শূদ্র’ এবং ‘ব্রাহ্মণীর’ সন্তানকে চন্ডাল বলা হয়েছে। (মনু: 10/12) শূদ্রপিতা এবং ক্ষত্রিয়া স্ত্রীর সন্তানকে ক্ষত্তা বলা হয়। ক্ষত্রিয় পিতা এবং শূদ্র স্ত্রীর সন্তানকে উগ্র বলে ধরা হয় (মানু 10/9)। এই ক্ষত্তা দ্বারা উগ্র জাতির মিলনে যে সন্তান হয়েছে সে হলো স্বপক বা স্বপচ। এই স্বপচরা গুুুহায় বাস করে, এবং দিনের বেলায় লোকালয়ে বিচরণ করে না। এরা কৈলাচারীর মতো কঠোর জীবন যাপন করে।
মনু বলেছেন এরা সমাজ থেকে বিরত এমন কি শূদ্র থেকেও নিকৃষ্ট। ― এসব কিন্তু মনুর আদেশে হয়নি। এসব বহু আগেই হয়েছে মনু কেবলমাত্র এসকল তাঁর শাস্ত্রে ব্যখ্যা করছেন। যারা মানুস্মৃতি পড়েছেন তারা দেখবেন প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পাঁচটি শ্লোকেই মনুর কাছে ঋষিরা এই সব জাতপাত সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। এবং তাদের মনু ক্রমশ সৃষ্টিতত্ব থেকে শুরু করে ভিন্ন ভিন্ন বর্ন এবং জাতির কর্ম কর্তব্য গুলো ব্যখ্যা করছেন। তিনি জাত পাত তৈরি করেননি। সমাজই এসব তৈরি করেছে।
“শ্রদ্দাধানঃ শুভাং বিদ্যামাদদীতাবরাদপি।অন্ত্যাদপি পরং ধর্মং স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি॥” (মনু: 2/238)
―শ্রদ্ধা সহকারে মঙ্গলজনক বিদ্যা শূদ্র থেকেও গ্রহণ করবে। চন্ডালের কাছ থেকেও শ্রেষ্ঠ ধর্ম শিক্ষণীয়, নিকৃষ্ট বংশের থেকেও উত্তম স্ত্রী বিবাহ করবে।
কোনটি মনুর বর্ননা, কোনটি মনুর আদেশ। এটা যারা বোঝেনা। তারাই মনুসংহিতার ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব অনুবাদ করেছে। সেইজন্য মনুসংহিতা জ্বালানো হয়েছে ভারতের রাজপথে। এতে অপমানজনক কিছুই নেই, এতে তাদেরই হীনতা এবং অশিক্ষার রূপ ব্যাক্ত হয়েছে।
মনু প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি সতন্ত্রতা। এই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তি সতন্ত্রতা এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা। যেখানে প্রত্যেকের নিজ নিজ ক্ষেত্র এবং অধিকার সংরক্ষিত থাকে এবং অপদকাল ব্যতীত নিজ নিজ ক্ষেত্রে যতদূর সম্ভব উন্নতি করতে পারে। কেউ কারো অধিকার দখল করতে পারবে না। যোগ্যতা থাকলেও না। এতে করে সমাজের সকল ক্ষেত্র গুলো নিজ নিজ দিক থেকে সবল হতে পারে এবং বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত কুশলতা এবং কর্মসংস্থানের ফলে রাষ্ট্রকে কখনোই আর্থিক মন্দা, বেকারত্বের হার বৃদ্ধির মুখ দেখতে হয় না। এটাই বর্নব্যাবস্থার কারণ।
তাই, জাতিবাদের মূল উৎস এই সমাজই । প্রকৃতিগত দিক থেকে দেখলেও আমরা দেখবো যে, পিঁপড়া, মৌমাছিদের পরস্পরের মধ্যে রানী, কর্মী, পুরুষ এরকম ভেদ আছে। কেউ মধু সংগ্রহ করে, কেউ ঘর বানয়, কেউ পাহারা দেয়, কেউ লার্ভাদের খাওয়ায় ইত্যাদি। আমরা মানুষ, তাই আমাদের নিয়ম একটু আলাদা। আর আমরা তো এক এক ঋষিদেরই সন্তান। আমাদের মূল তো একই। কেউ বড় বা ছোটো নয়। কেউ কবের পুুত্ৰ, কেউ হবিস্মন্তর পুুত্র, সুুকালিনের পুুত্র। আমরা সকলেই ঋষিদের পুুত্ৰ। তাই শুধু বর্নের বিভাগেই শেষ নয়। গোত্র, কুল বিভাগও আছে।
এর পরের শ্লোকটি বলছে:- “সোমপা, হবির্ভুজ, আজপ্যা এবং সুকালিন যথাক্রমে কব, অঙ্গীরা, পুলস্ত এবং বশিষ্ট ঋষির পুত্র।” অতএব, এর থেকে এটা নিশ্চিত যে আমরা সকল বর্ণের লোক কোনো না কোনো ঋষিদেরই বংশ ধর এবং সেই সূত্রে (ধর্মের দৃষ্টিতে) আমাদের অধিকারের থেকে কর্তব্য পালন করাই বেশী জরুরী। মাথার রাখতে হবে যে জীবিকা এক জিনিস এবং কর্তব্য আলাদা জিনিস। কেউ চুরি করেও জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু এতে তার আত্মসম্মান বাড়ে না। যে নিজের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করে সেই সমাজে সন্মান পায়।
চতুঃর্বনের যুক্তি:
মানুষের মধ্যে কেউ ভালো ভাবনা চিন্তা করতে পারে। তাদের মতামত ও নীতি সমাজের কল্যাণ করতে পারে। তাই তাঁদেরকে বলা হলো তোমার অর্থ উপার্জনের চিন্তা করতে হবে না। তুমি নিজের বুদ্ধি লাগিয়ে সমাজের মস্তক হয়ে থাকবে। সকলের শিক্ষার ভার তোমার। তুমি ভিক্ষা, ও দান গ্রহণ করে জীবন নির্বাহ করবে। এরা ব্রাহ্মণ।
কেউ বলশালী এবং বুদ্ধিমান। তাঁকে বলা হলো, তুমি নিজের বাহুবল দ্বারা সমাজের অভন্তরীন এবং বাইরের শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। সমাজের রক্ষা পরিচালনা ও দণ্ড বিধানের দায় বহন করবে। এরা ক্ষত্রিয়।
কিছু লোকের মধ্যে বাহুবল বা নৈতিক তেমন নেই। কিন্তু তারা শ্রম দ্বারা নিজেদের জন্য রসদ উৎপাদন করতে এবং সম্পদ সঞ্চয় করতে পারে। তাদের বলা হলো, তুমি চাষাবাদ এবং ব্যবসা করে সমাজের সকলের ভরন পোষন করো। উদরে যেমন খাদ্য সঞ্চয় হয়ে সমগ্র দেহে পুষ্টি উপাদান সরবরাহ হয়। তুমিও উদরের মতো সমাজের ভরন পোষনের দায় বহন করবে।
এইভাবে যথাক্রমে ব্রহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য জাতির গুন এবং কর্ম ভাগ করা হয়েছে।
এরপর আরেক শ্রেণীর লোক দেখা গেল সংগীত, কারুকার্য, মৃৎশিল্প, নৃত্য কলায় পারদর্শী তারা নিজদের সেই সকল কৌশল(Skill) দ্বারা সেবায় নিয়োজিত হলো। যারা শ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজে উপযুক্ত। তাদেরকে বলা হলো তোমরা উক্ত তিন বর্ণের সেবা করবে এবং সমাজের সেবার দায় বহন করবে। এদের শূদ্র বলা হতো।
একবার নিজে চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন, এই চারটি বিভাগ কি এখনও নেই? বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, কবী, লেখক এরা ব্রহ্মণের কাজ করছে। পুলিশ, হোম গার্ড, আর্মি, নেতা, এরা ক্ষত্রিয়ের কাজ করছে। ব্যবসায়ী, বিনিয়গপতি, মার্চেন্ট, উৎপাদক এরা বৈশ্যের কাজ করছে।
অনেক মানুষের কাছে শাস্ত্রের নিয়ম যুক্তিহীন, বানোয়াট তাই উপযুক্ত যুক্তির দ্বারা এই চার বর্ণের মূল্ কনসেপ্ট বোঝান হয়েছে। যাদের শাস্ত্র উক্তি অযৌক্তিক মনে হয়। তারা উপরক্ত ব্যাখ্যা নিয়ে ভাবতে পারেন।
তাহলে শূদ্র কি ব্রহ্মণ হতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তর হ্যা এবং না দুই’ই হবে। কারণ, জন্মগত ভাবে যারা শূদ্র, তারা শূদ্রই থাকবে। এমনটি শাস্ত্রের বিধান। কারণ, তাঁর ঋষি গোত্রের পরম্পরার সম্মান করা এবং পালন করাই তাঁর ধর্ম। আবার, জন্মগতভাবে শূদ্রের মধ্যে যদি কেউ জীবনের পরম উৎকর্ষতা বা পরম উপলব্ধি লাভ করে। তবে সে শূদ্র হলেও একজন ব্রহ্মণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ইহা মহাভারতের ধর্মরাজ যমের পুত্র যুধীষ্ঠিরের উক্তি। অর্থাৎ, সেই শূদ্র ব্রাহ্মণের মতোই সম্মান পাবে। তাঁকে সন্ত, সাধু, মহাত্মা বলা হবে।
আবার, এটাও মনে রাখা দরকার যে, পরম্পরা দ্বারা বাধিত থাকার দরুন সে সমাজের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না। সেই মহাত্মা শুধুমাত্র শূদ্রদের গুরু হতে পারে কিন্তু ব্রহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যকে দীক্ষা দিতে পারবে না। কোনো ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা ব্রহ্মণ তার কাছে শিক্ষা গ্রহন করতে আসলে, সে মহাত্মা নিজে থেকেই তাদের শিক্ষা দেবে না। তবে উপদেশ দেবে। সেই শূদ্র মহাত্মা যজ্ঞ সূত্র ধারণ করতে পারবে না, শিখা রাখতে পারবে না, বৈদিক মন্ত্রের প্রণব মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারবে না। সে স্থানে, শূদ্র মহাত্মা শ্বেত বা হলুদ বস্ত্র ধারণ করবে। রুদ্রাক্ষ, তুলসী মালা ধারন করবে।
এই বর্ণ ব্যবস্থা জন্মগত নাকি যোগ্যতা অনুযায়ী?
বর্ণ মূলত এটি জন্মগত একটি ব্যবস্থা ছিলো কিন্তু পরবর্তীতে যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী এটির অধিকার বিভক্ত হয়ে যায়। মহাভারতে আমরা দেখতে পাই শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনের সারথি রূপে যুদ্ধ ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছেন। দাসী পুত্র বিদুর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রী হিসাবে কাজ করছেন, পঞ্চ পাণ্ডব ও দ্রৌপদী তাদের অজ্ঞাত বাসের সময় মৎস দেশের রাজা বিরাটের দাসত্ব করেছিলেন। এখন প্রশ্ন হলো কেন? এর উত্তর আগেই বলেছি। আমরা সবাই কোনো না কোনো ঋষিদের সন্তান। গুণ ও কর্তব্য কর্ম অনুযায়ী আমাদের দায়িত্ব পালনই আমাদের ধর্ম। তাই, পূর্ব পূরুষের নির্ধারিত বর্ণ ব্যবস্থাকে মেনে চলাই ছিলো হিন্দু জাতির স্বধর্ম।
বর্ন ব্যবস্থার পতনের কারণ:
কিন্ত, দেখা গেলো সমাজে সকল স্তরের মানুষেরা সেবা প্রদানের বদলে সুখ ভোগে আগ্রহী হয়ে যেতে পারে। যে ব্রহ্মণ বেদে পড়ে না, নিজের ব্রত পালন করে না সেও সন্মান চাইতে পারে, যে ক্ষত্রিয় যোগ্যতা নেই। সেও রাজা হতে ইচ্ছা করতে পারে, বৈশ্য অর্থ সম্পদ লুকিয়ে রেখে মুনাফা অর্জন করার জন্য অসদ পন্থা অবলম্বন করতেই পারে, শূদ্রও সেবার নামে মনিবের ক্ষতি করে ঠকাতে পারে। এই দিকটি চিন্তা করে সকলের জন্য কঠিন এবং বিধান নির্ধারণ করা হয়েছে। একেই রাজদণ্ড বলা হয়েছে। রাজদণ্ডই রাজধর্ম, এই রাজদণ্ড এতটা শক্তিশালী যে, রাজাও এর থেকে বড় নয়। ব্রহ্মণও নয়। যদি কোনো রাজা এর বিধান খণ্ডায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে। তবে সে নিজের পতন নিজেই ডেকে আনবে এবং কোনো রাজা যদি সৎ হয় তবে এই রাজদণ্ডের বিধানই তাকে রক্ষা করবে। এই রাজদণ্ড অনুসারে অসদ, চরিত্রহীন ব্রাহ্মণকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার বিধান আছে। ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রের জন্য বেত্রাঘাত এবং মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। নারী, শিশু এবং রোগীদের ওপর কোনো সাজা নির্ধারণ হয়নি।
আক্ষেপ সমাধান:
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, ব্রাহ্মণের বেলা শুধুমাত্র দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার বিধান আর বাকিদের জন্য এতো কঠিন বিধান কেন? উত্তর হলো। সেই ব্রহ্মণ যাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সে তার পরিচয়ের জন্য কোনো দিন কোনো রাজ্যে ঠাই পাবে কি? যদি কেউ দয়া বসে তাঁকে ঠাঁই দিয়েও থাকে, তবে সে কিন্তু আর ব্রাহ্মণত্ব ফিরে পাবে না। তাকে ভিনদেশী শূদ্রও সম্মানের চোখে দেখবে না।
এই ধরনের ব্রাহ্মনরাই ম্লেচ্ছ বলে পরিচয় পায়। এরাই ভারতের বাইরে যবন সংস্কৃতি তৈরি করেছে। সম্ভত সেই কারণে, মিসর, গ্রীক, রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে ভারতীয় দেবী দেবতা এবং সাংস্কৃতিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
সংশয় সমাধান:
এই বর্ণের ভেদাভেদ আসলে discrimination বা পক্ষপাত নয়। এই ভেদাভেদ সমাজে সন্তুলন বা Balance বজায় রাখার কৌশল বলতে পারেন। এখন লোকতন্ত্র চলছে। আজও, SC, ST, OBC, General, Handicap, Minority এভাবে সমাজকে ভাগ করা হয়েছে এবং দুর্বলকে উন্নতির জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই সুযোগের কি অপব্যবহার হচ্ছে না? কেন হচ্ছে? কারণ এই সুযোগটা দিচ্ছে বিশেষ এক শ্রেণীর লোক, যারা নেতা বলে পরিচিত। তাদের টিকে থাকার জন্য জন সমর্থন চাই। এদের government বলা হয়। Govern কথার অর্থ হলো নিয়ন্ত্রণ করা বা শাসন করা। অর্থাৎ এখনো এলদল লোক আছে যারা শাসনতন্ত্র চালাচ্ছে। আবার এমন লোকও আছে যারা বৌদ্ধিক ক্ষমতা প্রয়গ করে দেশের মানুষদের ভালো মন্দ বোঝাচ্ছে। এখনো ব্যবসায়ী, কৃষক, ইন্ডাস্ট্রিজ গুলো সকলের জন্য উৎপাদন করে যাচ্ছে। অথচ আমরা বলছি শুধুমাত্র মহারাজ মনুই মানুষের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করেছেন।
তাই বুঝতে হবে, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অর্থাৎ হিন্দুরা শাশ্বত বিধান মেনেই জীবন যাপন করে। এবং সেই বিধান মেনেই তাকে সাধারণ থেকে আধ্যাত্মিক জীবনের দিকে নিয়ে যায়। এবং এটাই সুখের আসল পথ। সুখ বাইরে থাকে না। সুখ দুঃখ সব মনেরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ।
তাই যদি কোনো দেশ বা রাষ্ট্রের সকলেই আধুনিক যুক্তি, প্রযুক্তি বা সামাজিক মর্যাদা দিয়ে সম্পূর্ণ সুখী হতে পারে। তবেই তারা মনু সংহিতায় প্রশ্ন করার যোগ্যতা অর্জন করবে। এমন একটা দেশ দেখান। যেখানে সামাজিক বিদ্রোহ হয় না। দেখতে পারবেন না।
আমরা মনুকে দোষারোপ করি। ব্রাহ্মণ্যবাদ নিয়ে কুকথা বলি। কিন্তু এতে মনুর মতো ঋষিদের দোষ কোথায়?? মনু তো তাঁর স্মরণাপন্ন ঋষিদের উদ্দেশ্যে এই সকল জাতি প্রজাতির উৎপোত্তির কথা গুলো উল্লেখ করেছেন মাত্র। শ্রী রাম শবর জাতির বৃদ্ধার এঠো খেয়ে, চন্ডালের দ্বারা শিব রাত্রির ব্রত আরম্ভ করে আমাদের সংস্কৃতির ঋষিরা আমাদের সব সময় ব্রহ্ম তত্ব জানানোর চেষ্টা করেছেন॥ সকলেই ব্রহ্ম, কেউ উচ্চ বা নীচ নয়।
0 Comments: