ভূমিকা:
মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে কাল যবনের যুদ্ধের কথা অনেকেই জানেন। যেই কাল যবনের সাথে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ যুদ্ধ করেছিলেন। এই কাল যবন ছিল একজন অজেয় ও পরাক্রমী বীর। তাঁকে কোনো অস্ত্র দ্বারা পরাজিত করা অসম্ভব ছিল। কারণ, তিনি ব্রহ্মার কাছে আশির্বাদ প্রাপ্ত ছিলেন।
অর্থাৎ, সেই যবন জাতির উল্লেখ মহাভারতের যুগে বর্ণিত হয়েছে। আজকের গ্রীক, পারস্য, ইয়ামন দেশের মুসলমান, ইহুদীরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের আমরা যবন বলে জানি। এদের একত্রে ম্লেচ্ছ বলা হয়।
মহাভারত যুগে বা তাঁর পূর্বে কিভাবে যবন, ম্লেচ্ছ জাতির উদ্ভব হলো, আসুন আমরা জেনে নেই।
ব্রহ্মার পুত্ররা
পুরান অনুসারে প্রজাপিতা ব্রহ্মার বাম অঙ্গ থেকে শতরূপা এবং দক্ষিণ অঙ্গ থেকে স্বয়ম্ভু মনু প্রকট হয়েছিলেন। যেহেতু প্রথম মনো য় স্বয়ং ব্রহ্মার অংশ তাই তাহাকে স্বয়ম্ভু মন বলা হয়। স্বয়ম্ভু মনুর সংকল্প দ্বারা ব্রহ্মার মানষ পুত্রগণ ভৃগু, পুলস্ত্য, পুলাহ, ক্রতু, অঙ্গিরস, মারিচী, দক্ষ, অত্রি এবং বশিষ্ঠ প্রকট হয়েছিলেন।
এ ছাড়াও চারজন চির কুমার — সনক, সানন্দন, সনাতন এবং সনৎকুমার ব্রহ্মার মানস পুত্র ছিলেন।
দক্ষ প্রজাপতি ছিলেন ব্রহ্মার মানষ পুত্র। যিনি ছিলেন এই ভূ লোকের রাজা। এই ঋষিদের মানষপুত্র এজন্যই বলা হয় কারণ, এনারা ব্রহ্মার মন দ্বারা সমাজের বিশেষ বিশেষ বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
মহামুনি বশিষ্ঠ, তাঁর একটি কামধেনু ছিল। সেই ধেনুর নাম ছিলো শবলা। সেই কামধেনুটি বশিষ্ঠের সকল কামনা পূরণ করতে পারত। ভৃগু, পুলস্ত্য, পুলাহ, ক্রতু, অঙ্গিরস, মারিচী এনারা এই ভু-লোকেই বাস করতেন। এদের সংকল্প ও তপস্যা বলে এই জগতের ভিন্ন ভিন্ন জীব, প্রাণী, দেবতারা প্রকট হয়েছেন। আজকের এই আলোচনায় অত্রি ঋষির বংশধর কৌশিক, যিনি পরবর্তীতে বিশ্বামিত্র ঋষি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন, তাঁর সম্পর্কে জানবো।
ঋষি অত্রির বংশধর
ঋষি অত্রির বংশধর, চন্দ্র বংশের ক্ষত্রিয় রাজপুত্র কৌশিক ছিলেন একজন পরাক্রমি বীর। তিনি বশিষ্ঠ ঋষির সঙ্গে এক বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। সেই বিবাদ থেকেই কৌশিক পরবর্তীতে বিশ্বামিত্র ঋষিতে পরিণত হয়। আসুন বিস্তারিত সেই বিবাদ ও তাঁর ঋষি হওয়ার গপ্ল আলোচনা করি। এখানেই লুকিয়ে আছে যবন জাতির উৎপত্তির কারণ।
ব্রহ্মার পুত্র ঋষি বশিষ্ট্যের ভ্রাতা অত্রি ঋষির বংশধর ছিলেন এই রাজা কৌশিক। রাজা কৌশিক ছিলেন চন্দ্র বংশীয় রাজা। অত্রি ঋষির পুত্র ছিলেন চন্দ্র দেব। চন্দ্র দেব অনুসূয়ার গর্ভে জন্ম গ্রহন করেন। তপস্যা করে মানুষই দেবতা হন। মহাকাশে যে জ্যোতিষ্ক কে আমরা দেখি, সেই চন্দ্র গ্রহ আসলে সেই দেবতার মৃন্ময় বা মুর্ত রূপ।
চন্দ্রের সন্তান হলেন বুধ। বুধের প্রপৌত্র জয়। জয়ের প্রপৌত্র গাধি, গাধির পুত্রর নাম ছিলো কৌশিক। এই কৌশিক পরবর্তিতে তপস্যা করে ঋষি বিশ্বামিত্র হন। সূর্য বংশী শ্রী রামের পূর্বপুরুষ ত্রিশঙ্কুকে এই বিশ্বামিত্র সশরীরে স্বর্গে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তূ দেবরাজ তাঁকে স্বর্গ থেকে বিতারিত করেছিলো।
রাজা কৌশিক ছিলেন সেই চন্দ্র বংশের বংশধর। দ্বাপর যুগে এই চন্দ্রবংশ থেকে জন্ম হয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণর। $ads={1}
একদা রাজা কৌশিক তার এক অক্ষৌহিণী সেনা (১০৯৩৫০ পদাতিক, ৬৫৬১০ অশ্ব, ২১৮৭০ হস্তী এবং ২১৮৭০ রথ) ও পুত্রদেরকে সাথে নিয়ে মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমের সামনে উপস্থিত হলে। ঋষি বশিষ্ট্য তাকে অতিথি রূপে গ্রহণ করলেন। তাঁর আপ্যায়ন করলেন।
তাদের আতিথিয়তার জন্য তিনি খুব সুন্দর ব্যবস্থাও করে ছিলেন। রাজা কৌশিক অবাক হলেন, একজন ব্রাহ্মণের এত সম্পদ কোথা থেকে আসলো? একজন সামান্য ব্রাহ্মণ হয়ে রাজার পদাতিক সেনা, অশ্বারোহী, রথী, মহারথীদের আপ্যায়ন কি করে সম্ভব?
বশিষ্ঠ জানালেন, তার কাছে শবলা নামক একটি কামধেনু আছে। তার সামনেই তিনি যাহাই প্রার্থনা করেন, কামধেনু তা পূরণ করেন। রাজা কৌশিকের বিশ্বাস হলো না। তাই তিনি স্বচক্ষে সেই চমৎকার দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
কামধেনুর সেই চমৎকার দেখে রাজা কৌশিকের মনে লোভ জাগলো। তিনি ঋষি বৈশিষ্ট্যকে এক লক্ষ শত কোটি গাভীর পরিবর্তে ওই এক সবলা কামধেনুর বিনিময় করতে চাইলেন।
বশিষ্ঠ উত্তর দিলেন এক কেন এক লক্ষ শত কোটি গাভির পরিবর্তনে ও তিনি ওই শবলা কে দেবেন না। বিশেষত এই গাভি তাঁর হব্য, কব্য, অগ্নিহোত্র থেকে আরম্ভ করে হোম, যজ্ঞ, আহুতি এবং তাঁর জীবিকার একমাত্র সম্বল। তিনি রাজানেট স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, "আমি কোন মুল্যে শবলাকে ছাড়বোনা"।
রাজা কৌশিক সোনা দানা থেকে শুরু করে হাতি, ঘোড়া এবং আরও অনেক কিছু দিতে চাইলেন, কিন্তূ বশিষ্ঠ এবার বলেই দিলেন: "আপনি বৃথা সময় নষ্ট করবেন না, আমি শবলাকে দেব না"।
বহুনা কিং প্রলাপেন ন দাস্যে কামদোহিনীম।
দান প্রত্যাখ্যান করায়, রাজা কৌশিক, অপমানিত বোধ করলেন। তিনি সমস্ত শিষ্টাচার, সভ্যতা ভুলে গেলেন। তিনি ঋষি বশিষ্ঠের আতিথেয়তার কোনো সম্মান রাখলেন না।
তিনি ওই কামধেনু সাবালাকে জোর করে নিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন। সাবালা বশিষ্ঠকে ছেড়ে যাবার সময় কাঁদতে শুরু করলো। বশিষ্ট সাবালাকে সৈন্য সৃষ্টি করে বিশ্বামিত্রের সঙ্গে যুদ্ধ করতে বললেন। গো মাতা সাবালা তাই করলেন। সাবালাক তখন শক, যবন, হুন প্রভৃতি দুর্ধর্ষ সৈনিক উৎপন্ন করলেন। এই ভাবেই এই দুর্ধর্ষ যবন জাতির উৎপত্তি হয়েছে।
রাজা কৌশিকের সেনাবাহিনী সেই সমস্ত দুর্ধর্ষ সৈনিকের কাছে পরাজিত হলেন। একে তো রাজার অপমান, উপরন্ত পরাজিত হওয়ার লজ্জায় তিনি ঋষি বশিষ্ঠের মত তেজস্বী ঋষি হওয়ার প্রতিজ্ঞা করলেন।
তিনি তার এক পুত্রকে সিংহাসনে বসিয়ে হিমালয়ে তপস্যা করতে চলে গেলেন । তিনি মহাদেবের তপস্যা করতে বসলেন। এই তপস্যার ফল নিয়ে বশিষ্ঠের সঙ্গে পুনরায় যুদ্ধ করতে গেলেন এবং আবারও ব্রাহ্মণের ব্রহ্মদন্ডের কাছে পরাজিত হলেন।
তখন এই শব্দটি প্রবল হল মানুষের মধ্যে যে ক্ষত্রিয়ের চেয়ে ব্রাহ্মণের শক্তিই বেশি। এরপর বিশ্বমিত্র ব্রহ্মঋষি হওয়ার জন্য তপস্যা করলেন। সেই তপস্যা সিদ্ধ হয়ে যখন তিনি ব্রহ্ম ঋষি হলেন। তখন কামধেনুর আর কোন প্রয়োজনই তার কাছে থাকলো না। $ads={2}
ব্রহ্ম ঋষি চাইলেই শত শত কামধেনুর পূরণ করতে পারেন। শুধু এখানেই নয়। একজন ব্রহ্ম ঋষি চাইলে নতুন দেবতা এবং স্বর্গ তৈরি করতে পারেন। ঋশি বিশ্বামিত্র ত্রিশঙ্কুকে সশরীরে স্বর্গে প্রেরণ করেছিলেন। স্বশরীরে স্বর্গে প্রবেশ করায় স্বর্গের রাজা ইন্দ্র ত্রিশঙ্কুকে পৃথিবীতে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বামিত্র ত্রিশঙ্কুকে পতিত হতে দেন নাই। কথিত আছে। এই ত্রিশঙ্কু স্বর্গ আর পৃথিবীর মাঝামাঝি কোন এক জায়গায় আটকে ছিলেন। সেখানেই স্বর্গের মতো আরেকটি ছদ্ম স্বর্গ আছে।
পরিশেষ:
অতএব এই আলোচনা থেকে আমরা জানলাম। তপস্যার বলে একজন ক্ষত্রিয় ঋষি হতে পারে। তপস্যার বলে মানুষ সশরীরে স্বর্গে যেতে পারে। তপস্যার ফলে, মানুষ দেবতা হতে পারে। তপস্যার বলে একজন কামুক পুরুষ প্রবৃতি থেকে নিবৃতির পথে অগ্রসর হয়। এবং সর্বোপরি আমরা এটাও দেখলাম যবন জাতির উৎপত্তি সত্য যুগে হয়েছিল।
0 Comments: