যথা হি চোরঃ স তথা হি বুদ্ধ- স্তথাগতং — রামায়ণে বুদ্ধের নাম উল্লেখ করা আছে কেন ?
যথা হি চোরঃ স তথা হি বুদ্ধস্তথাগতং নাস্তিকমত্র বিদ্ধি। তস্মাদ্ধি যঃ শক্যতমঃ প্রজানাং স নাস্তিকে নাভিমুখো বুধঃ স্যাৎ ।। বাল্মীকি রামায়ণে 2/ 109//34 নম্বর শ্লোকটির অনুবাদ, করা হয়েছে—
“যেমন চোর, সেইরকম বুদ্ধ (বেদবিরোধী বৌদ্ধ- মতাবলম্বী) তথাগতকে নাস্তিক বলে জানবেন। সেইজন্য প্রজাদের মধ্যে যিনি যোগ্যতম, তিনি কখনও নাস্তিকের অভিমুখী হবেন না।” –এই অনুবাদটি কতোটা সঠিক সেটা বিচার করা দরকার, কারণ শ্রী রামের জন্ম ত্রেতাকালে। বুদ্ধের বহু যুগ আগে।
আর হিন্দুরা ভগবান বুদ্ধকে শ্রীহরি বিষ্ণুর অবতার হিসেবেও মেনে আসছে। তাহলে বুদ্ধকে চোর বলার কারণ কি? আর রামের সময় তো বুদ্ধের থাকার কথা নয়। এই তথাগত এবং বুদ্ধ শব্দটি রামায়ণ মহাকাব্যে কিভাবে এলো? আসুন বিচার করে দেখি।
কোনো কিছু প্রমাণ করতে হলে সাক্ষ্য দরকার। প্রত্যক্ষ, অনুমান, এবং বিশ্বস্ত উৎস বা ব্যক্তির দ্বারা যা পাওয়া যায়, তাহাই প্রমাণ। এই ভিত্তি কেউ অস্বীকার করবে না। আসুন আমরা এমনই কিছু প্রত্যক্ষ প্রমাণ এবং বিশ্বস্ত উৎসর প্রমাণ বিচার করে দেখি । আজকের বিষয় গুলো নিম্নরুপ:
ধর্ম নিয়ে বিবাদ
অনেকেই অনেক কথা বলে। অনেকের মতে রামায়ণের এই শ্লোক বিকৃত করা হয়েছে বলে মনে করেন। অনেকের মতে সম্পূর্ন রামায়ণটাই বুদ্ধের পরবর্তীতে লেখা হয়েছে বলে দাবী করা হয়। এরকম অনেক তর্ক বিতর্ক আছে।
শুধু বুদ্ধ বনাম রাম নয়। বিষ্ণু বনাম কালি, কালি বনাম কৃষ্ণ, এই ভাবে হিন্দু বনাম মুসলিম, মুসলীম বনাম ইহুদী, ইহুদি বনাম হিটলার, ইত্যাদি ইত্যাদি বিবাদের শেষ নেই। কেউ নিজেরটা নিয়ে সুখী হতে পারে না। ঈর্ষা, অভিমান এবং নিজেকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা নিয়ে একে অন্যের খেলাফ করে। এই সব কিছুই মানুষের অজ্ঞতা ও রাজনীতির অন্তর্গত।
যারা বলে আমরা রাজনীতির মধ্যে ধর্মকে মেশাই না। আসলে তারাই ধর্মকে ঢাল করে বার বার রাজনীতির ময়দানে ধর্মের বস্ত্র হরণ করে। আবার যারা বলে, আমরা ধর্ম রক্ষার জন্য রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করি। তাঁরা সত্য কথাই বলে। ধর্মের রক্ষা করা উচিত।
একদা হিটলার ইহুদীদের নির্মম ভাবে হত্যা করেছিলো। সেথায় রাজনীতির মূল ছিলো জাতি জাতি বিদ্বেষী পক্ষপাত। হিটলার ইহুদীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গিয়েই এই ঘৃণ্য কাজ করেছিল। কারণ তার মনে ইহুদীদের প্রতি ছোটো বেলা থেকেই ঘৃণার জমে ছিলো।
ভারত পাকিস্থান বিভাজন সেটাও Hindu-Muslim বিবাদ থেকেই উৎপন্ন হয়েছিলো। কতো হাজার হাজার মানুষের জীবন গেছে বলে শেষ করা যাবে না।
যারা সেক্যুলার, সামাজিক বিপ্লবে বিশ্বাসী, তারাও কোনো না কোনো ভাবে এই ধর্মীয় বিবাদ থেকে আলাদা করে কিছু করতে পারছে না। তারাও ধর্মের রাজনীতিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। কারণ মানুষের সব থেকে কাছের জিনিস এই রিলিজিয়ন।
যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না এবং যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে —তারা উভয়ই পরষ্পরের বিরোধ করে। এক পক্ষ ভাবে ধর্মই শান্তি বজায় রাখতে পারে। আরেক পক্ষ ভাবে ভাবে, যত অশান্তি এই ধর্ম থেকেই। তাই দুই জনের মাথায় ধর্ম ছাড়া কিছুই নেই। একে অপরের পরিপূরক।
তাই, যে যা বলে। তাকে বলতে দাও। নিজ ধর্ম কর্ম নিজের কাছে। কিন্তু বিবাদ যখন উঠেছি, বুদ্ধ আগে না রাম আগে, মুরগি আগে না ডিম আগে। সেই বিষয়ে কথা বলতে ক্ষতি কি?
বুদ্ধ আগে, না রাম আগে?
যদি ভগবান বুদ্ধ রামের আগে আসে তবে বুদ্ধের জীবনীতে ভগবান রাম বা সীতা, লক্ষণ, ইত্যাদির উপাখ্যান থাকা সম্ভব নয়। এর বিপরীতে যদি ভগবান রাম বুদ্ধের আগে আসে, তবে ভগবান বুদ্ধের নাম উল্লেখ্য তাঁর সমসাময়িক হওয়া উচিত নয়।
বুদ্ধের ধর্ম গ্রন্থ বা জীবনী পড়লে আমরা অনেক শব্দ প্রমাণ পাই যেমন, বুদ্ধ জাতি ও বর্ণের ভেদাভেদের তুলে মানুষকে বাস্তব জীবনের সত্য ও জীবনের কঠিন সত্যকে গ্রহন করার কথা বলেছেন। তিনি বহু ব্রাহ্মন পণ্ডিতকে তাঁর যুক্তি ও তর্ক দ্বারা পরাজিত করে নিজের শিষ্য করেছেন। শুধু তাই নয়, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জাতক অর্থাৎ ভগবান বুদ্ধের পূর্ব জন্মের গল্প গুলোতে বুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতি, পূর্বজন্মে বুদ্ধ কিভাবে জীবন যাপন করেছিলেন সেই সব কথা উল্লেখ করা আছে। সেখানেই আমরা শ্রী রামের উল্লেখ পাই ।
বৌদ্ধ জাতকে রাম, লক্ষণ সীতা।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ৪৬১ নং জাতক যার নাম ‘দশরথ জাতক’। সেখানে রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, সীতা ও দশরথের কথা বলা হয়েছে। এখানে রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, ও সীতাকে দশরথের সন্তান হিসেবে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ এখানে রাম-সীতাকে ভাইবোন হিসেবে দেখানো হয়েছে।
সেই জাতক কথা মতে ভরত যিনি মহারাজ দশরথের দ্বিতীয় স্ত্রীর পুত্র। তিনি তার পুত্রের জন্য মহারাজ দশরথের কাছে বর চান। ভরত সিংহাসন দখল করবে বলে দশরথের ইচ্ছায় নিজের প্রাণ বাঁচাতে রাম-সীতাকে নিয়ে বনবাসে পালিয়ে যায়। এরকম একটি গল্প রচনা করা হয়েছে।
কিভাবে বুঝব কোনটা সত্য ?
বেশিরভাগ জাতক কথায় বেনারসের রাজা ব্রহ্মদত্ত কে বলা হয়েছে, যার 16 হাজার পার্ট রানী ছিলো।
এই জাতকে বেনারসের রাজা হিসেবে দশরথকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। যার 16 হাজার পাঠ রানী ছিলো।
এই জাতক কথা গুলো ভগবান বুদ্ধ বলেছেন, যেখানে তিনি পূর্বজন্মের কথা বলছেন।
অতএব, বুদ্ধ জাতকে রামায়ণের শ্রী রাম ও মাতা সীতাকে যে ভাবে বিকৃত করা হয়েছে, সেটা আলাদা করে, এটা অনুমান করা যেতেই পারে। জাতক কথাগুলো আধুনিক এবং কল্পিত।
এটা একটা প্রমাণ দেয় যে, বৌদ্ধ উপাসকরা নিজেরাই রামকে বুদ্ধের পূর্বে স্বীকার করেছেন। এবং পূর্ব জন্মে বুদ্ধ রাম হিসেবে নিজেকে স্বীকার করেছিলেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রামের জন্ম বুদ্ধের আগে তাই রামায়ণ ও বুদ্ধের আগে।
তাহলে বাল্মীকি রামায়ণে 2/ 109//34 নম্বর শ্লোকটি কি অর্থ বহন করে? সেখানেও তো বুদ্ধ এবং তথাগত উভয় শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। আসুন সেই রহস্যও বোঝার চেষ্টা করি।
রামায়ণে বুদ্ধের নাম?
রামায়ণের দ্বিতীয় অধ্যায়, অযোধ্যা কান্ডর ১০৯ম অধ্যায়ের ৩৪ নম্বর শ্লোকে পাওয়া যায়। এর প্রসঙ্গ এই রকম — দশরথ নন্দন রাজকুমার শ্রীরাম রাজা হওয়ার জন্য মনোনীত হলে যখন সকল অযোধ্যা নগরীবাসী আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছিল। ঠিক সেই সময়, রানী কৈকেয়ী তার দাসী মন্থরার কুমন্ত্রনায়, রাজা দশরথের সামনে ভরত কে রাজা করার প্রস্তাব এবং রামকে বনবাসে পাঠানোর শর্ত রাখেন। ভরত সেই সময় অযোধ্যায় ছিলেন না। পিতার বাক্য সত্য হয়, সেই শর্ত মেনেই শ্রী রাম বনবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
ভরত অযোধ্যায় ফিরে আসেন এবং শুনতে পান, শ্রীরাম রাজ সিংহাসন ত্যাগ করে বনবাসে গিয়েছে। তিনি রামের খোঁজ করতে করতে রাজ্জানুবর্গ ও বিদ্যাণ ঋষিদের নিয়ে রাম কে অযোধ্যায় ফিরে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করেন।
তখন জাবালি নামক একজন চার্বাক ঋষি, শ্রীরামের এই সিদ্ধান্তকে ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবে শ্রী রামকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। জাবালি বলেন, “হে রঘু নন্দন, আমার মতে আপনার মতো শ্রেষ্ট, বুদ্ধিমান, সুপুরুষকে এমন বৃথা চিন্তা করা উচিৎ নয়। এই সংসারে কে কার বন্ধু? কার কাছে কার কি প্রাপ্য? জীব একাই জন্ম নেয় এবং একাই মৃত্যু বরন করে। তাই আপনাকে এই কন্টক পূর্ণ এবং উঁচু-নিচু পথের দূর্গম জীবন ছেড়ে আপনার পিতার রাজ সিংহাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত।"
এর জবাবে শ্রী রামের উক্তি যা বাল্মিকী রামায়ণে লেখা হয়েছে সেটি নিম্নরূপ:
সত্যং চ ধর্মং চ পরাক্রমং চ ভূতানুকম্পাং প্রিয়বাদিতাং চ। দ্বিজাতিদেবাতিথিপূজনং পন্থানমাহুস্ত্রিদিবস্য সন্তঃ ॥ ৩১॥
সাধক গন বলেন, সত্য, ধর্ম, পরাক্রম, জীবে দয়া (সেবা), প্রিয়বচন, দেবতা ব্রাহ্মণ ও অতিথি- পূজন-এইগুলিই দিব্য লোকে গমনের পথ।
তেনৈবমাজ্ঞায় যথাবদর্থ- মেকোদয়ং সম্প্রতিপদ্য বিপ্রাঃ। ধর্মং চরন্তঃ সকলং যথাবৎ কাক্ষন্তি লোকাগমমপ্রমত্তাঃ ।। ৩২
তাই, অপ্রমত্ত ব্রাহ্মণগণ এই কথার যাথাত্য অনুধাবন করে বিধিবৎ ধর্মাচরণ দ্বারা ব্রহ্মলোক প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা করে থাকেন।
নিন্দাম্যহং কর্ম কৃতং পিতৃস্তদ্যন্ত্রামগৃহাদ বুদ্ধ্যানয়ৈবং বিধয়া চরন্তং
বিষম বুদ্ধিম্। সুনাস্তিকং ধর্মপথাদপেতম্ ।। ৩৩
এই শ্লোকটি আরেক জায়গায় এই ভাবে লেখা হয়েছে —
নিন্দাম্যহং কর্ম পিতুঃ কৃতং তদ্যস্ত্বামগৃহ্ণাদ বিষমস্থ বুদ্ধিম্৷ বুদ্ধ্যানযৈবংবিধযা চরন্তং সুনাস্তিকং ধর্মপথাদপেতম্৷৷
উভয় ক্ষেত্রেই এর অর্থ— "আমি আপন পিতার এই কর্মের নিন্দা করছি যা আপনার মত বিষম বুদ্ধিমত্তা কে গ্রহন করেছেন। এই ধরনের (বিষম) বুদ্ধি ধর্মপথ থেকে পতিত করে চরম নাস্তিকে পরিণত করে।"
এখানে "বুদ্ধ্যানুযৈবং" এর অর্থ হলো "বুদ্ধি অনুযায়ী" বা "বুদ্ধিমত্তার অনুসারে"। "বুদ্ধ্যা" বা "বুদ্ধি" শব্দটি বুদ্ধি বা বোধ সম্পর্কিত, আর "অনুযৈবং" শব্দটি অনুসারে বা অনুসরণ করে এই অর্থ ব্যবহার করা হয়। সুতরাং, "বুদ্ধ্যানুযৈবং" বোধশীলতা বা বুদ্ধির পরিমাণের অনুযায়ী অনুসরণ করে বা এর অনুসারে একটি ক্রিয়া বা অবস্থা বিবেচনা করে। এর পরের শ্লোক টি দেখুন:
যথা হি চোরঃ স্তথা হি বুদ্ধস্তথাগতং নাস্তিকমত্র বিদ্ধি।তস্মাদ্ধি যঃ শক্যতমঃ প্রজানাং স নাস্তিকে নাভিমুখো বুধঃ স্যাৎ ॥৩৪॥যেমন চোর, বুদ্ধও তেমনি। জেনে রাখুন তথাগতরা নাস্তিক। তারা মানুষের মধ্যে সবচেয়ে অবিশ্বাসী পুরুষ। একজন বিদ্বান মানুষের উচিত নাস্তিকদের এড়িয়ে চলা।
— হ্যা আপনি ঠিকই পড়ছেন। এখানে বুদ্ধ ও তথাগত উভয় শব্দই উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকেই এটি বিক্ষিপ্ত বলে মনে করেন। কারণ শ্লোকটির বর্তমান প্রসঙ্গের সঙ্গে কোনো অর্থ স্পষ্ট হয় না। ত্রেতা যুগে বুদ্ধ ও তথাগত ছিলো না। তাই এর কোনো অর্থ হয় না।
তাই, আমাদের এই ‘বুদ্ধ’ বা ‘তথাগত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ব্যাবহার করতে হবে। আপনি কি জানেন "বুদ্ধ" কি কোনো ব্যক্তির নাম ছিলো?
না, কোনো বুদ্ধ কোনো ব্যাক্তি নয়। বুদ্ধ কথার অর্থ হলো ‘বুদ্ধি’ বা ‘বোধি প্রাপ্ত হাওয়া'। বুদ্ধ ধর্ম অবলম্বনকারী বৌধরা বলেন, তারা বুদ্ধ বা বুদ্ধের মূর্তির পূজা করেন না। তাঁদের "বুদ্ধ্যং স্মরনং গচ্ছামি” শব্দটি বোধ বা জ্ঞানের স্মরণ নেওয়ার কথা বলে। তাই 'বুদ্ধস্' কথার অর্থ বুদ্ধি এবং ' তথাগতং' শব্দের অর্থ 'যে প্রকারে সেটি আগত' । এভাবে বলতে হবে।
তথাগত শব্দের সন্ধি বিচ্ছেদ করলে দাড়ায় "তথা + আগত" অর্থাৎ "যে প্রকারে সেটি আগত।"
৩৩ নম্বর শ্লোকটি বলছে, “বুদ্ধ্যানয়ৈবং” সেখানে ‘বুদ্ধ্যানয়ৈবং’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে বুদ্ধি। তাই, বুদ্ধ শব্দের অনুবাদ বুদ্ধিই হবে।
এবার ওই শ্লোকটি সঠিক অর্থ দিয়ে এবার পড়ুন: — "যেমন চোর, (বিষম) বুদ্ধিও তেমনি। জেনে রাখুন যে প্রকারে এই নাস্তিকতা (যারা বেদ মানে না তারা) এসেছে। তারা মানুষের মধ্যে সবচেয়ে অবিশ্বাসী পুরুষ। একজন বিদ্বান মানুষের উচিত নাস্তিকতাকে এড়িয়ে চলা।
এই শ্লোকে বলা হলো যে, পূর্বের দ্বিজজনদের (অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য) বেশি কর্ম করে অনেক অনুকূল কর্ম পূর্ণ করতো। তারপরে, তারা সমস্ত লোকের (ছিত্ত্বা আর সদ্যম) উন্নতি করেছিলেন। এবং তারা যারা ভালো কর্ম এবং যাগ্য কর্ম পূর্ণ করেছিলেন।
—স্পষ্টত, শ্রী রাম তাঁর পিতা দশরথের বাণী যাতে মিথ্যা না হয়ে যায়। সেই সত্য ব্রত পালনের জন্যে রাজ সিংহাসন ও রাজ মুকুটকে তুচ্ছ করে বনে গিয়ে বনবাসীর জীবন যাপন করছেন। পিতার প্রতি শ্রী রামের এই ত্যাগ সাধারণ মানুষের ধারনার অতীত।
তাহলে নাস্তিকদের চোর বলার পেছনে কারণ কি?
আসলে বেদ নিন্দুকদের নাস্তিক বলা হয়। তারা নিজের কুট বুদ্ধির দ্বারা ধর্ম শাস্ত্রকে নিজের সুবিধা অনুযায়ী বিকৃত কোরে অন্যায়কে ন্যায়, এবং অ-নীতকে নীতি বলে প্রচার করে। এমন দূর্বুদ্ধি ব্যক্তি পরমার্থ থেকে সর্বদাই বিচ্যুত হয়ে যায় এবং সে যে পথে চলে, সেটি চোরের মতই অসৎ পথ।
কারণ চোর কখনই সামনের দরজা দিয়ে ঢোকে না। সে অন্যায় ভাবে অন্যের সম্পদ হরণ করে। শুধু নিজের সুখের জন্য তিনি অনীতিকে নীতি হিসেবে গ্রহন করতে প্রত্যাখ্যান করেছেন
সেই রকম বিকৃত অনৈতিক বক্তব্যই শ্রী রামকে জাবালি করেছিলেন। এই ধরনের চারু বাক বা পুষ্পিত বাক্য বা (speak gracefully) সোমৃদ্ধ লোকেদের চার্বাক বলা হয়।
এই চার্বাক দর্শন বলে, "যতদিন বাজবে সুখে বাঁচবে প্রয়োজন পড়লে ঋণ করেও ঘি খাবে।" এর অর্থ হলো, বেঁচে থাকার জন্য যদি আপনি অনৈতিক ভাবে কোন কিছু করেন তবে সেটাও তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। চার্বাক দর্শন মতে, অন্যকে দুঃখ দিয়ে, ছলনা করে, নিজে সুখ ভোগ করতে করতে বেঁচে থাকাটাই জীবনের স্বার্থকতা। তাই, শ্রী রাম জাবালিকে সাবধান করে দিয়েছেন।
এমন মিষ্টি মিষ্টি বাস্তববাদী কথা বলা চারুবাক জাবালির বুদ্ধিকে রাম ধিক্কার করেছেন। কারণ, চার্বাক নাস্তিকদের কেউ বিশ্বাস করে না। তারা সময়কে ভোগ করতে সুযোগ খোঁজে। এতে করে কার কি ক্ষতি হোলো, কার জীবনে কি প্রভাব পড়লো সেটা বিচার করে না। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নিংড়ে ভৌতিক সুখ ভোগ করাই তাঁদের জীবনের অন্তিম লক্ষ্য।
পরিশিষ্ট
এই উক্ত 'বুদ্ধ 'এবং 'তথাগত' শব্দ দু'টি ভগবান বুদ্ধের নামকে নির্দেশ করছে না। বুদ্ধ কোনো ব্যক্তির নাম নয়। গৌতম বুদ্ধ হলেন বৌদ্ধধর্মের ২৮তম বুদ্ধ ও একজন তপস্বী ও জ্ঞানী। সিদ্ধার্থ গৌতম, শাক্যমুনি বুদ্ধ, এমন বহু বুদ্ধ আছেন। এবং ভবিষ্যতে আসবেন। এই ‘বুদ্ধ’ একটি উপাধি মাত্র। যদি আমরা আমাদের দেশের বুদ্ধের জীবনী পড়ে দেখি। সেথায় বুদ্ধের নাম ছিল সিদ্ধার্থ। এই সিদ্ধার্থ ছিলেন রাজা শুদ্ধোধন ও মায়াদেবীর সন্তান পুত্র।
একদিন শাক্যমুনি রাজা শুদ্ধোধনের রাজ সভায় এসে হাজির হন। তিনি সিদ্ধার্থকে দেখে তাঁর ভবিষ্যত বাণী করে চলে যান। সিদ্ধার্থ বৈরাগী সন্ন্যাসী হবে। রাজা চিন্তিত হয়ে সিদ্ধার্থকে ভোগ বাসনায় ডুবিয়ে রেখেছিলেন। এরপর একটি ঘটনা সিদ্ধার্থের মন ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। তিনি জীবনের সত্যকে খুঁজতে খুঁজতে গয়ার এক বট বৃক্ষের নিচে বসে, ধ্যানমগ্ন হয়ে, বোধি প্রাপ্ত হয়ে, সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধ নামে পরিচিত হন।
সম্পর্কীত ভিডিও
প্রচলিত “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি” —এর অর্থ বুদ্ধ নামক কোনো ব্যাক্তির স্মরনাপন্ন হওয়া নয়। নিজের মধ্যে মুক্তির বীজ জাগিয়ে বুদ্ধকে জাগরিত করে তোলা। কারণ, বুদ্ধ নিজেই বলেছেন আমি তোমাদের মুক্তি দিতে পারবো না। তোমরা নিজেরাই নিজের মুক্তির পথ খুঁজে নেবে। রামায়ণে সেই বুদ্ধের উল্লেখ নেই। রামায়ণ প্রসঙ্গটি জবালির বিষম বুদ্ধির কথা বলেছে।
0 Comments: