
আল্লাহ এবং হিন্দু ঈশ্বরে পার্থক্য কি?
আল্লাহ এবং ঈশ্বরে মূলে কোনো পার্থক্য নেই তবে ভাব ও বোধে বিশাল পার্থক্য আছে। আল্লাহ এবং ঈশ্বর ভিন্ন ভিন্ন নাম মাত্র। আমরা নিজ নিজ ভাষা অনুযায়ী ভিন্ন নামে তাঁকে ডাকি। আল্লাহ এবং ইশ্বর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এক নয়। এখানে সেই বৈশিষ্ট গুলোর পার্থক্য নিরূপণ করবো।
আল্লাহ শব্দ আরবী ভাষার ‘আল ইলাহ্’ দুই শব্দের সন্ধি করে তৈরী হয়েছে। আরবীতে ‘আল’ ইংরেজীতে The এর মতো এবং , ‘ইলাহ্’ এর অর্থ হলো "একমাত্র ইবাদত যোগ্য"। অর্থাৎ যিনি একমাত্র ইবাদত যোগ্য কর্তা, তিনিই আল্লাহ। সেই জন্যে মুসলিমরা বলে, "লা(নেই) ইলাহ (মাবুদ) ই্লাল্লাহু(আল্লহ ব্যতীত )"। আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। এই আল্লাহই মুসলিমদের একমাত্র পূজনীয় সত্তা।
হযরত মুহম্মদের পিতার নাম আবদুল্লাহ ছিলো। আবদুল্লাহ কথার অর্থ হলো— আল্লাহর বান্দা। অর্থাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই আরবে হযরত মুহাম্মদ ও তার পূর্বপুরুষরা আল্লাহ নামক মাবুদের সিজদা করতো। সেই সময় লাত, মানাত, উজ্জা, হাবাল নামক দেবতা ও দেবীর পূজা হতো। হাবাল দেবতার উদ্দেশ্যে নরবলিও দেওয়া হতো। হাবাল দেবতার উদ্দেশ্যে হজরত মুহাম্মদের পিতা আবদুল্লাহর নাম নরবলির লটারতে উঠে এসেছিল। তারপর আবদুল্লাহর নামে ১০টি করে ১০বারের বার প্রয়াসে মোট ১০০টি উটের বিনিময়ে সেই বলি থেকে রক্ষা পান। আল্লাহ নামে অবশ্যই কোনো দেবতা আরবে আগে থেকেই ছিলো, তাহা না হলে আবদুল্লা এই নাম কিভাবে সম্ভব? কথিত আছে, হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এই সব কুসংস্কার থেকে আরব মুক্ত করেন। এবং একমাত্র ইশ্বর আল্লহর উপাসনা চালু করেন।
কোরআন মতে আল্লাহর জন্ম বা মৃত্যু নেই, এই আল্লহর কোনো রূপ নেই, তিনি অদৃশ্য, তাঁর পিতা, স্ত্রী, সন্তান কেউ নেই। তাঁর ওপরে কেউ নেই, তাঁর সমান কেউ নেই। তিনিই সৃজন করে এবং জগত পালন করেন। তাঁর তুল্য কেউ নেই, কাবার ওপর তিনি আরশের উপর বিরাজমান। তিনি গায়েব জানেন এবং যা জাহির তাও জানেন। অর্থাৎ তিনি অপ্রকাশিত জানেন। গায়িব হল একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ লুকানো বা সুপ্ত ("অদৃশ্য")। এর দ্বারা শুধু "স্বর্গদুত, স্বর্গ-নরক, স্বর্গীয় রাজত্বকে বোঝায় না, বরং ভবিষ্যতের আসন্ন ঘটনাকেও বোঝায়, যা একমাত্র আল্লাহই জানেন"। মুসলীম মতে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যকার কাউকে এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেন না। আল-কুরআন, সূরা আল-মায়েদাহ : ৯০ নম্বর আয়াত:
“নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ধারক তীরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কর্ম ছাড়া আর কিছুই নয়, সুতরাং তোমরা এগুলো থেকে বিরত থাকো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার’’।
ঈশ্বর শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় ইশ+বর এই দুই পদের সংযোগে তৈরী। ঈশ্বর শব্দের অর্থ হলো 'যিনি অনিষ্ট থেকে রক্ষার করেন এবং অভিষ্ঠ পূরণ করেন'। তাই, ঈশ্বর এক বা বহু হতে পারে।
ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়:
আমরা দেখলাম আল্লাহ আর ঈশ্বর এক অর্থ বহন করে না। জগতকে অনিষ্ট থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনি জগদীশ্বর। ভূত ও গণেদের যিনি রক্ষা করেন, তিনি ভূতেশ্বর। এভাবেই নাগেশ্বর, কালেশ্বর, মহেশ্বর ভিন্ন ভিন্ন ইশ্বর সত্ত্বা হিন্দু ধর্মে আছে। এই ভিন্ন ভিন্ন ইশ্বর এক ও অভন্ন রূপ এক ও অদ্বিতীয় সচিদানান্দ সদা শিবের ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও নাম। ভিন্ন রূপ ও নামে ওই এক ঈশ্বরই বহু হয়েছেন। তাই ওই এক ইশ্বরের দ্বিতীয় কোনো রূপের পূজা হলে তিনি ক্রোধ করেন না।
সাকার ও নিরাকার:
ইশ্বর সাকার ও নিরাকার উভয় ভাবেই সত্য। দেবতা রূপে তিনি সাকার কিন্তু ব্রহ্ম রূপে তিনি নিরাকার। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, ইন্দ্র, বরুণ, আদিত্য প্রভৃতি দেবতারা সাকার এবং মায়ার অধীন। কিন্তু এঁদের মূল স্বরূপ নিরাকার।
নিরাকার বলতে এখানে অদৃশ্য বা আকার রহিত বলা হয়নি। নিরাকার কথার অর্থ— 'যার আকার নিরূপন করা সম্ভব নয়'। যেমন অপরূপ এবং অপব্যাখ্যা উভয় ক্ষেত্রেই ‘অপ’ শব্দের প্রয়োগ একদম আলাদা। অপব্যাখ্যা বলতে আমরা কোনো কিছুর ভুল ব্যাখ্যা বুঝি, কিন্তু অপরূপ বলতে আমরা কুরুপ বুঝি না। অপরূপ শব্দটিকে আমরা 'রূপকে অতিক্রম করে যায়, এমন কিছু' বোঝাতে ব্যবহার করি। সেভাবেই নিরাকার বলতে আকার রহিত না হয়ে, আকার নিরূপন সম্ভব নয় বা পরিমাপ করা সম্ভব নয় এমন কিছু বুঝতে ব্যবহার করি।
আমরা যখন কোনো ব্যথা অনুভব করি সেটিকেও নিরাকার বলা চলে না। কারণ সাপের কামড়, পিপঁড়ার কামড়, আর বিছা পোকার কামড় এক নয়। মৌ মাছি হুল ফোটালে সেটা আমরা পিপঁড়ার কামড়ের মতো আনুভব করি না। অর্থাৎ ব্যাথাকেও পরিমাপ করা বা তুলনা করা সম্ভব।
ঈশ্বর জন্ম ও মৃত্যু রহিত। তাই ইশ্বর অনাদি এবং অনন্ত। সেই অন্তহীন ও আদিরও আদি ইশ্বর সর্বত ভাবে পূর্ন।
নির্লিপ্ত:
ঈশ্বর সর্বত ভাবে নির্লিপ্ত; অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ এই কোনো কিছুই তাঁকে বিচলিত বা অনুপ্রাণিত করে না। কারণ এই কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ সবই তাঁর সৃষ্ঠ। যেভাবে মাকড়সা জাল বনন করে নিজে সেই জালে জড়িয়ে পড়ে না, ঈশ্বরও নিজের তৈরী কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহে জড়ান না। আল্লাহ বিভিন্ন কারণে ক্রোধ করেন। তাই আল্লাহ ইশ্বর হতে পারে না। ঈশ্বর নির্লিপ্ত।
সৃজন কর্তা স্রষ্ঠা নন:
মাকড়সার জাল মাকড়সার দেহ থেকে নির্গত হয়। তাই জাল ওই মাকড়শার সৃজন। কবি নিজের মনের কথা শব্দের দ্বারা কবিতার রচনা করেন, তাই সেটি কবির সৃষ্টি।
পূর্ব থেকে উপলদ্ধ উপকরণ দিয়ে যা কিছু নির্মাণ করা হয়, তাকে সৃষ্টি বলা হয়। সৃষ্টি হলো নতুন কিছুর উৎপাদন করা। স্টিভ জবস নিজে মোবাইল স্ক্রীন, ক্যাপাসিটার, ব্যাটারি ইত্যাদি উপকরণ বানায়নি। তিনি কেবল ওই Mac OS ডিজাইন করেছেন। আইজ্যাক নিউটন নিজে অভিকর্ষ বল উৎপাদন করেননি। তিনি কেবমাত্র অভিকর্ষ বলকে গাণিতিক সূত্র দ্বারা প্রমাণ ও উল্লেখ করেছেন।
সৃজনের ক্ষেত্রে আগে থেকে কোনো উপকরণ থাকে না। তাই সৃজনের ক্ষেত্রে নির্মাণ বা উৎপাদন করা হয় না। সৃজনের ক্ষেত্রে একবারে নতুন উপাদান রচনা করা হয়। তাই ব্রহ্মাকে বেদে সৃষ্টিকর্তা বলা হয়নি, তিনি সৃজন কর্তা বা সৃষ্টির রচয়িতা। আল্লাহ বা যোহিবা এরা সৃষ্টিকর্তা।
কুরআন থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে ওই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন ভূমি, আকাশ, জল ও চরাচর জগত। তারপর আল্লহ পাহাড় কে দৃঢ় ভাবে স্থাপন করেছেন।
অন্য দিকে ঈশ্বর নিজেই জগত রূপে প্রকট হয়েছেন এবং সৃষ্টির নিমিত্ত কারণ রূপে সর্বত্রই বিরাজ করছেন। তাই তিনি সৃষ্টির পূর্বে, বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে সর্ব কালে, সর্ব অবস্থায়, এক ভাবেই সর্বব্যাপী হয়ে আছেন।
কোরআন হযরত মুহাম্মদ কে শেষ নবী বলেছে। অর্থাৎ তাঁর পর আর কোনো নবী আসবেন না। কোনো আসমানী কিতাব নাজিল হবে না। অর্থাৎ কোরআন হলো আল্টিমেট নলেজের বই। তাই কি?
কোরআন ও বাইবেলের কোথাও জগৎ সৃষ্টির পূর্বে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বা যোহবার অবস্থান সম্পর্কে বলেনি। ফেরেশতা, জিন, কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে সেই সম্পর্কে কিছুই বলেনি। তাই কোরআন আল্টিমেট নলেজ নয়।
আমরা দেখেছি আল্লাহ মাঝে মাঝেই ক্রুদ্ধ হয়ে আযাব (অভিশাপ) বর্ষণ করেছেন। তিনি যদি সৃষ্টি কর্তা হতেন, তাঁর মধ্যে এই ক্রোধ কোথা থেকে এসেছে সেটা উল্লেখ নেই। ক্রোধ তো সাধারণ জীবের লক্ষণ। কামনায় বাধা হলে সামান্য জীবের হৃদয়ে ক্রোধ উৎপন্ন হয়। যেখানে আল্লহ নিজের কামনা দ্বারাই স্রষ্টা জগৎ সৃষ্টি করেছেন। তবে তিনি সেই জগতের মন্দ কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না কেন? নিজের সৃষ্টির ওপর তিনি কিভাবে ক্রোধ করতে পারেন? এমন সকল উত্তর আমরা পাই না। কোনো মুফতি বা আলেম এই সকল প্রশ্নের দলিল সহ জবাব দিতে পারবেন।
হিন্দু ধর্মের পুরাণ অনুসারে সৃজন কর্তা ব্রহ্মা, ভগবান বিষ্ণুর নাভী কমল থেকে প্রকট হয়েছেন। আবার অন্য কল্পে ব্রহ্মার বাম অঙ্গ থেকে ভগবান বিষ্ণু প্রকট হয়েছেন। ব্রহ্মার ক্রোধ থেকে 11 জন রুদ্র প্রকট হয়েছেন। সৃজন কর্তার এই ক্রোধ রুদ্র। সেটা পূরণে স্পষ্ট ভাবেই বলা হয়েছে। এর পেছনে কারণ ছিলো ব্রহ্মার মানস পুত্রদের তাঁর আদেশের অবজ্ঞা। শিব পুরাণ অনুসারে সদা শিবের অঙ্গ থেকে প্রথমে বিষ্ণু এবং বিষ্ণুর নাভী থেকে ব্রহ্মা ভগবান প্রকট হয়েছেন। এই জন্যে পুরাণ গুলো বাস্তব নয়। তবে এর মধ্যে সত্য আছে। শ্রুতিকে প্রমাণ রেখে তত্ত্ব বোধ করলে আমরা জানতে পারি যে: “একই সত্য ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞ ভিন্ন ভিন্ন রূপে ব্যাখ্যা করেন।” ত্রিদেব তত্ত্ব হোক আর দেবী মহা পূরণের দেবী মহত্ব, সব ক্ষেত্রেই একই কথা বলছে। স্থূল জ্ঞানে ভিন্ন মনে হলেও মূলে কোনো ভিন্নতা নেই। ভিন্নতা হোলো বোধে:
- আল্লাহ একমাত্র ইবাদত যোগ্য, ইশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। উভয় এক জিনিস নয়।
- আল্লাহ সৃষ্টি কর্তা, ইশ্বর হলেন সৃষ্টির কারণ বা মূল।
- আল্লাহ ক্রোধ ও ক্ষোভ দ্বারা দূষিত, কিন্তু ইশ্বর নির্লিপ্ত।
- আল্লহর আদেশ না মানলে তিনি দণ্ড হিসেবে নরক শাস্তি দেন। ঈশ্বর একটা সিস্টেম তৈরী করেছেন, যেটা ক্রমে ক্রমে ভোগ করতে করতে জীব তাঁর স্বরূপ প্রাপ্ত হয়।
- আল্লাহ তাঁর শেষ নবী হিসেবে হযরত মুহম্মদকে দিয়ে তার শেষ কিতাব কোরআন পাঠিয়েছেন। ঈশ্বর বেদ জ্ঞান দিয়েছেন। যা এক রূপে সদা সর্বদা একই ভাবে বিদ্যমান আছে। ধর্মের গ্লানী হলে সয়ং তিনিই ধর্ম স্থাপনের জন্য অবতরণ করেন। কোনো দূত বা দালাল পাঠান না।
- আল্লাহ তাঁর উপাসকদের তাঁর উপাসনা বাদ দিয়ে অন্যান্য দেবতার উপাসনা থেকে বাধা দেয়। ইশ্বর বলেন, " আমার যে ভক্ত যেভাবে, যেমন বিধান দ্বারা, যে নির্দিষ্ট দেবতার উপাসনা করে, তাহা সর্ব ভাবে আমারই উপাসনা করে।" কারণ ইশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়।
হিন্দু ঈশ্বর ভক্তের ভাব গ্রহী। তিনিই তো জগত রূপে জগতের সকল রূপ। একটা নালীর কীট যদি ওই মল ভক্ষণ না করতো, যদি পচা মৃত দেহের জীবাণু না ধরতো , তবে মাটির পুষ্টি পদার্থ গুলো কিভাবে বিশ্লেষিত হতো? তাই, অনু, পরমাণু, জীবাণু সবেতেই ইশ্বর আছেন। কিন্তু ব্যবহারিক দিক থেকে ভালো ও মন্দের বিচার করেই ধর্ম-অধর্ম, পবিত্র-অপবিত্র, মিত্র-শত্রু, ন্যায়-অন্যায় বিবিধ বিষয় শাস্ত্রে নিরুপিত হয়েছে। যারা এই শাস্ত্রে নিরুপিত বিষয় অনুযায়ী চলে তারা কুলিন। কিন্তু যারা ব্রহ্ম কে জেনে, ব্রহ্ম রূপে, ব্রহ্মেই রমন ও অবস্থান করেন। তারা কৌল বা ব্রহ্ম জ্ঞানী।
আল্লাহ এবং ঈশ্বর নাম মাত্র। আমরা নিজ নিজ ভাষা অনুযায়ী তাদের সংস্কার অনুযায়ী ভিন্ন নামে তাঁকে ডাকি। আল্লাহ এবং ইশ্বর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এক নয়। কিন্তু মূলে তো ওই আস্তিকতার কথাই বলে।
0 Comments: