এটা জানলে আর কেউ ধর্ম পরিবর্তন করবে না, বরং হিন্দু ধর্ম গ্রহন করবে।
আমরা বিশ্বাস করি সকল ধর্ম এবং সকল ধর্মমত গুলো সত্য এবং ইশ্বর প্রদত্ত। স্থান কাল ও পাত্র ভেদে আমার ইশ্বর ধর্মী ও ধর্মের পার্থক্য করেছেন ঠিকই কিন্তু মূলে তিনি এক। সত্য এক, জ্ঞানীরা তাঁকে বহু ভাবে ব্যখ্যা করেছেন।
ভূমিকা:
হিন্দু থেকে দলে দলে মানুষ ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান হয়ে যাচ্ছে, অথবা মুসলীম হয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত আছে জেনে আমরা তাদের দিকে আঙ্গুল তুলে খ্রীষ্ট এবং মোহম্মদ (সা:) কে গালি দিচ্ছি। এর ফলে হচ্ছে এই যে, আমরাই সকলের দৃষ্টিতে খারাপ হয়ে যাচ্ছি। কারণ যারা ধর্মান্তরিত হয়েছে তাদের যা বলা হয়েছে। সেটাই তারা আমাদের মধ্যে দেখছে।
কোনো সমাজ ত্যাগ করে কেউ যখন অন্য সমাজে যোগ দেয়। সাধারণ নিয়মেই সে সমাজচ্যুত হয় এবং তার সম্পর্কে সমাজ খারাপ সমালোচনা করে। হিন্দু খ্রীষ্টান হলে যেমন হিন্দু সমাজে তার বদনাম হয়। খ্রিষ্টান হিন্দু হলে খ্রীষ্টান সমাজে তার বদনাম হয়।
তাই আমরা যে ধর্মান্তরীতদের গালি-গালাজ করছি। সেটাকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের ভাবমূর্তিকে ছোটো করে দেখানো হচ্ছে। তাদের যখন হিন্দু থেকে ধর্মান্তর করা হয়, তাঁদের এমন ভাবে মগজ ধোলাই করা হয়, যেন, প্রতিটি পদক্ষেপ অক্ষরে অক্ষরে আমাদের বিরুদ্ধে এবং তাদের পক্ষে কথা বলে। তখন তাদের চশমা পড়া আমাদের হিন্দু দেখতে পায়, সত্যিই তো আমার হিন্দু ধর্ম এতটা নীচ। দেবতার এতটা উগ্র, পৈশাচিক!
এরকম নিয়ন্ত্রিত একটা প্রয়োগ এমনই নিজের ওপর করে দেখুন। নিচের একটি একটি ধাপে আপনি নিজের পরীক্ষা করুন।
- ১) আপনি জিভ বের করে স্বাস নিতে পারবেন না।
- ২) এবার আপনি নিজের জিভ বের করে স্বাস নিতে চেষ্টা করছেন।
- ৩) জিভ বের করে এই প্রয়াস করার চেষ্টায় আপনাকে কুকুরের মতো দেখাচ্ছে।
- ৪) নিজের বোকামির জন্য আপনি হাসছেন।
অর্থাৎ আমি আপনাকে কৌশল করে আমার কথার দ্বারা পরিচালনা করতে বাধ্য করলাম। একে বলা হয় mind manipulation.
যখন আমার ধর্মান্তরীত ব্যাক্তিকে আমরা হিন্দু ধর্মের ভালো ভালো দিক গুলো উল্লেখ করি এবং তার সিদ্ধান্তকে ভুল বলার চেষ্টা করি। সে নিজের সিদ্ধান্তকে সঠিক করার জন্য আমাদের ভালো দিক গুলোর উপেক্ষা করে নিজের যুক্তিকে তুলে ধরে। আর যখন যুক্তিতে জিততে পারে না, তখন তিক্ত ভাষায় দেবী দেবতাদের তুলনা তাঁর আরাধ্য দেবতা নবীদের সঙ্গে করতে শুরু করে।
আমরা খ্রিস্টানদের উদ্দেশ্যে বা যীশুর উদ্দেশ্যে যখন ক্ষারাপ কথা বলি। তার সামনে বাইবেলের এই কথা গুলো এসে যায়—
এই কথাগুলো যীশু তাঁর শিষ্যদের যে উদ্দেশ্যে বলেছিলেন। সেই প্রসঙ্গ ছিল, — যখন যীশু কে সৈনিকরা চারি দিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তাঁর শেষ দিনে তিনি তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে ছিলেন। তখন তিনি এই কথা বলেছেন। যোহনের পত্রে এই প্রমাণ দেখুন
‘আমি তোমাদের অনাথ রেখে যাবো না৷ আমি তোমাদের কাছে আসব৷
যোহন 14:18
আর কিছুক্ষণ পর এই জগত সংসার আর আমায় দেখতে পাবে না, কিন্তু তোমরা আমায় দেখতে পাবে৷ কারণ আমি বেঁচে আছি বলেই তোমরাও বেঁচে থাকবে ৷
যোহন 14:19
সেই দিন তোমরা জানবে যে আমি পিতার মধ্যে আছি, তোমরা আমার মধ্যে আছ, আর আমি তোমাদের মধ্যে আছি৷
যোহন 14:20
যে আমার নির্দেশ জানে এবং সেগুলি সব পালন করে, সেই আমায় প্রকৃত ভালবাসে৷ যে আমায় ভালবাসে, পিতাও তাঁকে ভালবাসেন৷ যে আমায় ভালবাসে, পিতাও তাকে ভালবাসেন আর আমিও তাকে ভালবাসি৷ আমি নিজেকে তার কাছে প্রকাশ করব৷
যোহন 14:21
যীশুকে যখন রাজার সৈনিকরা খুঁজে বেড়াচ্ছিল, এবং তিনি নিজের সময় শেষ হয়ে আসছে বুঝতে পেরেছেন। তিনি সেই সময় তাঁর শিষ্যদের বিরোধীদের থেকে সাবধান করে ওই কথা গুলো বলেছিলেন। সেই সময় যীশু কাউকে ধর্মান্তরীত করছেন না, বরং তাঁর তিনি বলছেন— 'এরা (সৈনিকরা) আমার সঙ্গে যা করতে যাচ্ছে, তোমাদের সঙ্গেও তারা করবে। আমি বেঁচে আছি বলেই তোমরাও বেঁচে থাকবে৷' সেই ১২ জন শিষ্যকে যীশু বলছেন, তাঁরা এই জগতের নয়, জগত যেমন তার আপনজনদের ভালবাসে, তেমনি তোমাদেরও ভালবাসবে৷ যদি তাঁরা জগতের মতো চলে।যেহেতু যীশুর শিষ্যরা এ জগতের নয় , তারা আধ্যাত্মিক জগতের তাই জগত তাঁদের শুনবে না৷
যীশু যে সেই সময় নতুন কোনো ধর্ম প্রবর্তন করতে আসেনি তিনি সেটাও বলে গেছেন। তিনি প্রচলিত মোশির বিধি-ব্যবস্থা ও ভাববাদীদের শিক্ষাকে একটু আলাদা ভাবে উপস্থাপন করতে ইহুদীদের মধ্যে গিয়েছিলো।
যীশুর এই পরিবর্তন তৎকালীন ইহুদী ধর্মগুরুদের মধ্যে ঈর্ষা সৃষ্টি করে। তাই যীশুকে ঈশ নিন্দার অভিযোগে রাজার হাতে তুলে দেয়। "ঈশ নিন্দার" শাস্তি ছিলো মৃত্যু দণ্ড। সেটাই তাঁর সঙ্গে হয়েছিল।
যীশু বলছেন - মোশি বিধি-ব্যবস্থার "বিন্দু বিসর্গও লোপ হবে না।" তাহলে খ্রীষ্টান ধর্ম কিভাবে নিজেকে নতুন বিধান বলে চালাচ্ছে?
যখন তাদের বলা হয়, ‘অপরাপর লোকদের মত তোমারাও বিশ্বাস কর’, তারা বলে, ‘নির্বোধেরা যেরূপ বিশ্বাস করেছে আমরাও কি সেরূপ বিশ্বাস করব?’ সাবধান! এরাই নির্বোধ, কিন্তু এরা জানে না।(সূরা বাক্বারা ২:১৩)
এই আয়াত থেকে বোধ হয়। আল্লাহ আমাদের উদ্ধারের কথা বলছেন, কিন্তু যেহেতু আমরা অবোধ। তাই, আমরা তাঁর ইসলাম গ্রহন করছি না।
যারা অবিশ্বাস করেছে তুমি তাদেরকে সতর্ক কর বা না কর, তাদের পক্ষে উভয়ই সমান; তারা বিশ্বাস করবে না।(সূরা বাক্বারা ২:৭)
যদিও, আমারা এখানে ইসলামের সমালোচনা করবো না। মূলত যীশু খ্রীষ্টের আলোচনাই করবো। তাই, আসুন মূল আলোচনায় ফেরা যাক।
ভারতের বাসিন্দাদের সঙ্গে ওই যীশু খ্রীষ্টের কোনো যোগাযোগ ছিলো না। ভবিষ্যত পূরণে ঈশাপুত্র এমন একটি নাম আছে। যাহাকে ম্লেচ্ছদের পথ প্রদর্শক বলা হয়েছে। এইটুকুই।
ইহুদীদের ভাববাদী বা মোসির নিয়মের সঙ্গে দূর দূর পর্যন্ত আমাদের কোনো সম্পর্কই নেই। ভাববাদীরা যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সেগুলো মূলত পাশ্চাত্য ইহুদিদের পুরাতন নিয়ম (Old Testament) -এ পাওয়া যায়। এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল একজন মসীহের আগমন, যিনি ইসরায়েল এবং সমগ্র পৃথিবীর মুক্তিদাতা হবেন।
এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো যীশুর মধ্যে পূর্ণতা পায় বলে খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস করা হয়। Old Testament বা পুরাতন নিয়মে যা বলা হয়েছে সেই গুলোকে রেফারেন্স হিসেবে New Testament বা নতুন নিয়মে দেখানো হয়েছে যে — যীশুই সেই উদ্ধার কর্তা, যার কথা ভাববাদীরা ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন।
নিচে কিছু পুরাতন নিয়মের ভাববাদীদের পুস্তক এবং সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর তালিকা দেওয়া হলো, যা খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী যীশুর জীবনের মধ্যে পূর্ণ হয়েছে:
১. ইশাইয়ার পুস্তক (Isaiah)
ইশাইয়া ৭:১৪: _“দেখ, একটি কুমারী গর্ভবতী হবে এবং পুত্র প্রসব করবে, এবং তার নাম রাখা হবে ইম্মানুয়েল (ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে)।”
- খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন যে, এই ভবিষ্যদ্বাণী যীশুর জন্মের মাধ্যমে পূর্ণ হয়েছে, যেহেতু তিনি কুমারী মেরির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ইশাইয়া ৯:৬: _“আমাদের জন্য একটি শিশু জন্মেছে, আমাদের জন্য একটি পুত্র দেওয়া হয়েছে, এবং শাসনভার তার কাঁধে থাকবে। তাকে বলা হবে আশ্চর্য পরামর্শদাতা, পরাক্রমশালী ঈশ্বর, চিরস্থায়ী পিতা, শান্তির রাজকুমার।”
-যীশুকে এই "শান্তির রাজকুমার" হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি মানবজাতির মুক্তির জন্য এসেছেন।
ইশাইয়া ৫৩: পুরো অধ্যায়টি "দুঃখভোগী সেবক" সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে, যিনি অন্যদের পাপের জন্য কষ্ট সহ্য করবেন এবং বলি হবেন।
খ্রিস্টান বিশ্বাস অনুযায়ী, যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া এবং তার মাধ্যমে মানুষের মুক্তি লাভ এই ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতা।
২. মিখার পুস্তক (Micah)
মিখা ৫:২ “কিন্তু তুমি, বেতলেহেম ইফ্রাথা, যদিও তুমি ইহুদার ক্ষুদ্র গোত্রের অন্তর্ভুক্ত, তবুও তোমার থেকেই একজন আসবেন, যিনি ইস্রায়েলের শাসক হবেন...”
- এই ভবিষ্যদ্বাণী যীশুর জন্মস্থানের সাথে মিলেছে, কারণ তিনি বেতলেহেমে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
৩. যিহোনার পুস্তক (Zechariah)
যিহোনা ৯:৯— “সিয়োন কন্যা, আনন্দ করো! তোমার রাজা তোমার কাছে আসছেন, তিনি ন্যায়বান এবং বিজয়ী, নম্র এবং একটি গাধার বাচ্চার উপর চড়ছেন।”_
- যীশুর যিরুশালেমে গাধার বাচ্চার উপর চড়ে প্রবেশ করা এই ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতা হিসাবে বিবেচিত হয়।
৪. গীতসংহিতা (Psalms)
- এই লাইনটি যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সময় তাঁর মুখে উচ্চারিত কথা হিসেবে বিবেচিত হয়। পুরো গীতসংহিতা ২২ যীশুর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর পূর্বাভাস দেয়।
গীতসংহিতা ১১০:১—“প্রভু আমার প্রভুকে বললেন: আমার ডান পাশে বসো, যতক্ষণ না আমি তোমার শত্রুদের তোমার পায়ের নিচে রাখি।”_
৫.দানিয়েলের পুস্তক (Daniel)
দানিয়েল ৭:১৩-১৪: “মানুষের পুত্র আসবেন মেঘের সঙ্গে এবং শাসনভার, গৌরব, এবং রাজ্য তার হাতে দেওয়া হবে, যাতে সমস্ত জাতি, জাতি এবং ভাষার লোকেরা তাঁর সেবা করে।”
“মানুষের পুত্র” শব্দটি খ্রিস্টানরা যীশুর সাথে সম্পর্কিত করে, এবং বিশ্বাস করা হয় যে, এই ভবিষ্যদ্বাণী তাঁর পুনরুত্থান এবং চিরস্থায়ী রাজত্বের প্রতীক।
মসীহ সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী এবং যীশুর মধ্যে পূর্ণতা:
- মানুষের পাপের মুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা
- দরিদ্র এবং অত্যাচারিতদের মুক্ত করা
- ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা
- ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা
খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করেন যে যীশু এই সকল ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণ করেছেন, যীশুর জন্ম, তাঁর শিক্ষা, এবং মৃত্যু, মৃত্যুর পর পুনরুত্থান এবং ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মসীহের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন।
এর মধ্যে কোথাও হিন্দু ধর্ম বা বৈদিক ধর্মের সম্পর্ক নেই। আমাদের সংস্কৃতির দেবী দেবতা, অবতার, গীতা বেদ পূরণের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই, খ্রিষ্টানদের আমাদের ধর্ম নিয়ে ব্যখ্যা ও প্রচার আমাদের ওপর খাটে না।
যীশুর শিক্ষা এবং তাঁর আত্ম ত্যাগের যে উদ্দেশ্য ছিল, সেটি ইহুদিদের মধ্যেই সীমিত। অথচ খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, তাঁর বার্তা সারা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য ছিল।
এর প্রমাণ হিসেবে যীশু তাঁর শিষ্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন তারা বিশ্বের সমস্ত জাতির কাছে এই শিক্ষা পৌঁছে দেয়। মথি ২৮:১৯-এ যীশু বলেন:
"সুতরাং তোমরা যাও, এবং সব জাতির লোকদের আমার শিষ্য করো, তাদের বাপ্তিস্ম দাও পিতার, পুত্রের, এবং পবিত্র আত্মার নামে, এবং আমি তোমাদের যেসব নির্দেশ দিয়েছি, তা মানতে শেখাও।"
এই উক্তিটি যীশুর মৃত্যুর পুনরুত্থানের পরে ঘটে। যার উল্লেখ করে খ্রীষ্ট মিশনারীরা বলেন যে যীশু শুধু নির্দিষ্ট লোকের জন্য নয় বরং পৃথিবীর সকল জাতির জন্যই তাঁর বার্তা নিয়ে এসেছেন।
সেই বার্তার কি? তারা বলেন, "যদি তুমি যীশুকে গ্রহণ করো তবে তোমার আত্মা শেষ বিচারের দিন সুরক্ষিত হবে এবং অনন্ত জীবন পাবে" যদি গ্রহন না করি তবে? "তবে নরকের প্রহরী তোমাকে নরকের আগুনে ছুড়ে ফেলে দেবে।" কেন? আমি যদি একজন ভালো মানুষের মতো জীবন নির্বাহ করি, তবে কি আমি অনন্ত জীবন পাবো না? "না, কারণ যীশুই সেই জীবন বৃক্ষ।"
মথি ৭:২২-২৩-এ পাওয়া যায়। সেখানে যীশু বলেন:
"অনেকেই সেদিন আমাকে বলবে, ‘প্রভু, প্রভু, আমরা কি তোমার নামে ভবিষ্যদ্বাণী করিনি? তোমার নামে অশুভ আত্মাদের বের করিনি? এবং তোমার নামে অনেক আশ্চর্যজনক কাজ করিনি?’ তখন আমি তাদের স্পষ্টভাবে বলবো, ‘আমি কখনো তোমাদের চিনি না। আমার কাছ থেকে দূরে যাও, তোমরা যারা অন্যায় করছো।’"
এরকমই একটি প্রসঙ্গ লুকের পত্রে আছে। লুক ১৩ এর ২৪ থেকে ২৭ পর্যন্ত।
সেই সময় যীশু বিভিন্ন নগর ও গ্রামের মধ্য দিয়ে য়েতে য়েতে শিক্ষা দিচ্ছিলেন, এইভাবে তিনি জেরুশালেমের দিকে এগিয়ে চললেন৷ একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করল, "প্রভু উদ্ধার কি কেবল অল্প কয়েকজন লোকই পাবে?" তিনি সকলকে বললেন,
তাহলে দেখুন শুধু খ্রীষ্টের আনুগত্য হলেই উদ্ধার হবে না। আর আমরা হিন্দু বলে নরকে ছুড়ে ফেলা হবে, এমনটাও নয়। এরপর যীশু খ্রীষ্ট বলেছেন —
উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম অর্থাৎ তিনি। সমগ্র বিশ্বে যতো ধর্মমত মতান্তর আছে সেগুলোর কথা বলেছেন। সকলেই নিজ নিজ আসনে বসবে কিন্তু যারা যীশুর সঙ্গে ছিলেন বা আছেন তাদের মধ্যেও কিছু লোকই ওই সরু দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে।
আমরা যীশুকে ইহুদীদের গুরু হিসেবে তাঁর সন্মান করতেই পারি। কারণ ইহুদী জাতীর প্রতি তার ত্যাগের মহিমায় আমরা আপ্লুত। কিন্তু আমার ঈশ্বরকে সরিয়ে সেই ঈশ্বরের পুত্রকে আমার ঈশ্বরের আসনে বসাতে পারি না।
যোহন ১০:২৭-এ যীশু বলেছেন, "আমার ভেড়ারা আমার কথা শোনে, আমি তাদের জানি, আর তারা আমার পিছনে চলে।"
আমি তাঁর ভেড়া নই। আমার মাতা পিতা ও পূর্বপুরুষ যে পথে যে মেষপালককে অনুসরণ করছেন। আমি তাঁকেই অনুসরণ করবো। গীতায় ভগবান বলছেন:
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্ মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।
অর্থাৎ —যারা যেভাবে আমার (ভগবানের) ভজনা করে আমি (ভগবান) তাকে সেই ভাবেই তুষ্ট করি। হে পার্থ, মনুষ্যগণ সর্বভাবের মধ্য দিয়ে আমার পথই অনুসরণ করছে।
খ্রিস্টধর্মের মূল শিক্ষা এই যে, যীশু কেবল ইসরায়েলিদের জন্য নন, বরং সমগ্র মানবজাতির পাপের মুক্তির জন্য এসেছিলেন। হ্যা অবশ্যই, তাঁর জ্ঞানের অমৃত সুধা পৃথিবী সকল মানুষের জন্য উপকারী হতে পারে। ঠিক যেভাবে গীতার বাণী পৃথিবীর সকল মানুষ জাতির জন্য অমৃত বাণী।
তাই বলে একজন মুসলিম, বৌদ্ধ, শিখ নিজের পরম্পরা ত্যাগ করে যীশুকে কে কেন গ্রহন করবে? বা হিন্দু ধর্ম কেন গ্রহণ করবে? যা আমার ধর্মে আছে। সেটা কি যীশুর শিক্ষার থেকে আলাদা শিক্ষা?
আমরা দেখেছি খ্রীষ্টানরা অমর নয়। এখানে যীশু কি বলতে চেয়েছিলো আর ধর্ম প্রচারকরা কি বলছে?
খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচারকরা বলছে— "যারা যীশুকে গ্রহণ করেছেন তাহারা মৃত্যুর পর অনন্ত জীবন পাবে।"
যীশু এই উক্তি হাজার হাজার বছর আগে বেদন্তে বলা হয়েছে —
"শুনো, ওহে অমৃতের সন্তানরা, যাঁরা দিব্যধামে বসবাস কর, আমি সেই মহান পুরুষকে জানি। তাঁকে (ঈশ্বরকে) জানলে জন্ম ও মৃত্যুকে অতিক্রম করা যায়। এ ছাড়া মুক্তির অন্য কোনো পথ নেই।" তিনি কে? উপনিষদ বলে যে, মানুষ আসলে এই ব্রহ্মেরই অংশ, এবং আত্মজ্ঞান বা আত্মসাক্ষাৎকার লাভ করলে সে মৃত্যুর ঊর্ধ্বে উঠতে পারে।
"ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতি"—যিনি ব্রহ্মকে জানে সে নিজেই ব্রহ্ম হয়ে যায়। (মুণ্ডক উপনিষদ ২.২.৯)
"তত্ত্বমসি" —অর্থাৎ, তুমিই সে। (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.৮.৭)
"অহং ব্রহ্মাস্মি" — আমিই ব্রহ্ম (বৃহদারণ্যক উপনিষদ ১.৪.১০)
অর্থ: আত্মা শুধুমাত্র বক্তৃতা বা তর্কের মাধ্যমে, বিদ্যার দ্বারা বা বহু শোনা কথা থেকে লাভ হয় না। যে ব্যক্তি এই আত্মাকে চায় এবং যাকে আত্মা বেছে নেয়, সেই আত্মা নিজেকে প্রকাশ করে।(ঐতরেয় উপনিষদ (৩.৩.১২)
"প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম"— জ্ঞানই ব্রহ্ম। (ঐতরেয় উপনিষদ ৩.৩.১২)অর্থ:
আত্মার প্রকৃত জ্ঞানই ব্রহ্মের প্রকৃত রূপ। এই উপলব্ধি হলে আত্মা ও ব্রহ্মের মধ্যে কোনো ভেদ থাকে না। এই শ্লোকগুলো উপনিষদের মূল ভাবকে তুলে ধরে, যেখানে আত্মা ও ব্রহ্মের অভিন্নতার কথা বলা হয়েছে। আত্মজ্ঞান লাভ করাই মানুষের মোক্ষ বা চূড়ান্ত মুক্তির পথ।
স্বামী বিবেকানন্দ মুণ্ডক উপনিষদের এই বচনকে পশ্চিমী জগতে উপস্থাপন করেছিলেন এবং সেখানকার শত শত মানুষের মধ্যে আত্মচেতনার জাগরণ ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর সেই বাণীতে হাজার হাজার খ্রীষ্টান নর নারী বেদান্তের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে হিন্দু ধর্মে শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের আশ্রয়ে এসেছিলেন।
খ্রীষ্টান মিশনারীরা তাঁদের ধর্মীয় শিক্ষায় ভারতীয় হিন্দু যুবক যুবতীদের বলেন, "তোমাদের দেবী দেবতারা অস্ত্র হাতে ভয়ংকর রূপে যা দেখলেই ভয় লাগে। এগুলো কি ঈশ্বর হতে পারে?" আমাদের ঈশ্বর দেখ— "কত সাধারণ, তাঁর রূপ। দুই হাত এলিয়ে ডাকছে, পাপীর পাপ তিনিই ক্ষমা করতে পারেন। তিনি হিংস্র নন। তিনি পাপীদের হত্যা করতে আসেননি বরং তাদের উদ্ধারের জন্য নিজেই ক্রুশ বিদ্ধ হয়েছেন।"
সেই ধর্ম প্রচারকদের কাছে আমার প্রশ্ন, তিনি পাপীদের হত্যা করতে আসেননি ঠিকই কিন্তু তিনি তো পাপীদের পুড়িয়ে পুড়িয়ে কষ্ট দেওয়ার জন্য নরক বানিয়েছেন। এই পাপের ক্ষমা তো তিনি নিরপেক্ষ ভাবে করছেন না। তার জন্যে তিনি কিছু শর্ত রেখেছেন। যে Ten Commandments খ্রীষ্টান ধর্ম মেনে চলে, সেই অঙ্গীকার কি ঈশ্বর ভাঙ্গতে পারেন?
আমাদের হিন্দু বৈদিক দেবী দেবতার কোনো শর্ত বা অঙ্গিকার নেই। এই জীবনের পরেও মানুষকে বার বার পুনর্জন্মের দ্বারা নিজেকে শুধরে নেয়ার অবকাশ দেওয়া হয়। কিন্তু পাশ্চাত্য ধর্মে জীবন তো একটাই। তাহলে ন্যায়ের এই ফারাক তো আছেই।
আমাদের দেবী দেবতার হাতের সেই অস্ত্র তাঁর ভক্তদের ভয় দেখিয়ে নিজের পূজা পাওয়ার জন্য নয়, বরং যে শয়তান বা অজ্ঞানী মানুষ পবিত্র মনকে সংশয় দ্বারা ভ্রমিত করে। সেই অজ্ঞানী এবং ভ্রমিত মানুষদের ভয় দেখানোর জন্যই এই অস্ত্র।
শ্রী রামের হাতের তীর-ধনুক রাবণের হত্যার জন্য ওঠেনি। স্বামী হিসেবে তিনি নিজের স্ত্রীকে ফেরত আনতে গিয়ে ছিলেন। রাবণ বলে ছিলো, বীরের মতো যুদ্ধ করে নিজের স্ত্রীকে ফিরিয়ে নাও। এই পরিস্থিতিতে শ্রী রাম কি রাবণকে ক্ষমা করে দিয়ে বোলতে পারে, “আমার বউকে তুই নিজের কাছে রেখে দে। আমি তোর পাপ ক্ষমা করবো।” ভগবান যখন নিজেই পাপীর পাপের বিচার করেন, তিনি কৃপা ক্ষমা আর প্রেম করেন না। তখন তিনি বিকট রূপ ধারণ করেন
মহাভারতের যুদ্ধে দূর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ন যেভাবে দ্রৌপদীকে অপমান করে রাজ সভায় বিবস্ত্র করেছিল এবং যে অনৈতিক ভাবে পান্ডবদের রাজ্য কেড়ে ১৬ বছর বনবাস ১ বছর অজ্ঞাত বাস পন করে ছিলো। সেই সব শর্ত পূরণ করেও নিজের রাজ্য ফেরত চাইলে, কৌরবরা বলেছিল "সূচের নখের সমান মাটিও দেবো না। রাজ্য চাইলে যুদ্ধ করে জিতে নাও"। রাজা হিসেবে পাণ্ডবরা কি তাদের অপমান ক্ষমা করে দিতে পারতেন? অর্জুন যুদ্ধ ক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে গিয়েও বিষাদ গ্রস্ত হয়েছিল। শ্রী কৃষ্ণ বলেছিলেন, তুমি যুদ্ধ কোরো বা না করো। কাল এদের গ্রাস করবে অর্থাৎ একদিন এদের মৃত্যু হবেই। আজ, এই যুদ্ধ ক্ষেত্রে এদের ন্যায় না করলে যমের দ্বারে এদের ন্যায় হবে।
ক্ষত্রিয়রা যুদ্ধে মৃত্যু বরণ করলে স্বর্গে যাবে, বিজেতা হলে পৃথিবীতে সুখ ভোগ করবেন। কিন্তু তুমি যদি তা না কোরো, তবে তুমি এই পৃথিবীতে তো সুখী হবেই না, মৃত্যুর পরও তুমি স্বর্গের সুখ পাবে না। কারণ, তোমার ভাই ও আত্মীয় স্বজন সকলের দুঃখের কারণ তুমিই হবে।
এই ধর্ম সংকটে অর্জুনকে শ্রী কৃষ্ণ যে যে তত্ত্ব বলেছেন, সেই সকল জ্ঞান আজ আমাদের জন্য অমৃত সুধা।
পাপীদের পাপ ক্ষমা ঈশ্বর তখনই করেন যখন কেউ নিজের ধর্ম পাপকে স্বীকার করে ঈশ্বরের চরণে সমর্পন করেন। তা সে হিন্দু হোক বা খ্রীষ্টান, মুসলিম হোক বা অন্য যে কোনো ধর্ম মতাবলম্বী।
মানুষকে জন্মগত বা পাপী বলার মতো পাপ এই দুনিয়ায় নেই। শিশু পাপ নিয়ে জন্মায় না। নির্বোধের পাপ পূণ্য নেই। যীশুর নাম থেকেই যে পাপ মোচন হবে এমন কোনো কথাও যীশু অস্বীকার করেছেন (মথি ৭ এর ২২-২৩)।
যদি খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেই সব পাপ ক্ষমা হয়।তাহলে এই যুক্তি নিয়েই বলছি। রোমের পোপ নিজের রাজকীয় পদ থেকে নেমে আসুক সাধারণ মানুষের কাছে। যেভাবে যীশু খ্রীষ্ট সাধারণ মানুষের মতো জীবন নির্বাহ করছেন। রোমান ক্যাথলিক চার্চের সব সম্পত্তি সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হোক। মৃত্যুর পর যেভাবে অখ্রীষ্টান ব্যক্তির ওপর যীশুর নামে সকলের পাপ ক্ষমা করা হয়। জীবিত অখ্রীষ্টান সকল ব্যক্তির পাপ ক্ষমা করা হোক।
পোপ যে এই জগতের সুখ সমৃদ্ধি ও সম্মানের সাম্রাজ্য ভোগ করছেন, সেই সাম্রাজ্য তো যীশুর সাম্রাজ্য তো নয়। যীশুর সাম্রাজ্য তো এই দেহ মন্দিরের ভেতরে।
আসলে যারা ধর্ম প্রচারক সেজে আমাদের হিন্দু ধর্মের দেবী দেবতার ওপর প্রশ্ন চিহ্ন অঙ্কন করে তাঁরা ধর্ম অধর্মের ফারাক বোঝে না। তারা যীশুর নামে মিথ্যা শিক্ষা দেয়। ভেড়ার দলে তারা নেকড়ে।
মথি ৭:১৫ (Bible: Matthew 7:15) “সাবধান থেকো মিথ্যা ভাববাদীদের থেকে। তারা তোমাদের কাছে আসে ভেড়ার মতো পোশাক পরে, কিন্তু ভিতরে তারা হিংস্র নেকড়ে।”
তাহা না হলে কিভাবে তারা অন্য ধর্মকে কটাক্ষ করতে পারে? নেকড়ের বাচ্ছা নেকড়েই হয়। নেকড়ের বলছি, কারণ তারা আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। ভেড়ার ওপর ভেড়া আক্রমণ করে না।
আমি হিন্দু , আমার ভেড়ার দলের ওপর যারা আক্রমণ করে তারা নেকড়ে নয় তো আর কি? দেখুন—
এখানে পল "দুধ" বলতে সহজ শিক্ষার প্রতীক হিসেবে এবং "শক্ত খাবার" বলতে আরও গভীর আধ্যাত্মিক শিক্ষা বোঝাতে চেয়েছেন, যা সেই সময় ইহুদীরা যারা খ্রীষ্টের পথে হেঁটেছেন। তখনো কঠিন জ্ঞান গ্রহণ করার মতো প্রস্তুত ছিল না।
যীশু তাঁর শিক্ষা প্রসঙ্গেও শিষ্যদের এই একই আধ্যাত্মিক পরিপক্বতার কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাঁদের অনেক সময় কঠিন বিষয় বুঝতে না পারার কথা বলেছেন।
যোহন ১৬:১২-তে যীশু বলেন: "আমার তোমাদের বলার জন্য এখনো অনেক কিছু আছে, কিন্তু তোমরা সেগুলি এখন সহ্য করতে পারবে না।"
এখানে যীশু ইঙ্গিত দেন যে, শিষ্যরা তখনো পরিপূর্ণভাবে তাঁর শিক্ষার গভীরতা বুঝতে প্রস্তুত নয়। তবে, তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে পরবর্তীতে পবিত্র আত্মা (Holy Spirit) এসে তাঁদেরকে সব সত্যের দিকে পরিচালিত করবে এবং জ্ঞানের গভীরতর দিকগুলো উদ্ঘাটন করবে।
পবিত্র আত্মার আগমন বাইবেলের নতুন নিয়মের প্রেরিতদের কার্য (Acts of the Apostles)-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত রয়েছে। পেন্টিকোস্টের দিন পবিত্র আত্মা (Holy Spirit) সকলের মধ্যে নেমে আসে। সেদিন আকাশ থেকে এক প্রচণ্ড বায়ু প্রবাহের মতো আওয়াজ হয় এবং তা সারা ঘর আলোয় ভর্তি করে ছিলো, যেখানে তারা বসে ছিল। আর আগুনের জিহ্বার মতো কিছু দেখা গেল, যা ভাগ হয়ে প্রত্যেকের উপর স্থির হয়ে থাকল। এর পর তারা সবাই পবিত্র আত্মায় পূর্ণ হলো এবং বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে শুরু করল, যেমন সেই পবিত্র আত্মা তাদেরকে বলবার ক্ষমতা দিয়েছিল।
কিন্তু যীশু খ্রীষ্ট কি এরকম কোনো ঘটনা ঘটবে। এরকম কোনো কথা বলেছিলো? যীশু খ্রীষ্ট তো বলেছিলেন পবিত্র আত্মা আসবে এবং জ্ঞানের গভীরতর দিকগুলো উদ্ঘাটন করবে। পবিত্র আত্মা এসে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে শেখাবে এটা তো কথা ছিলো না। ভাষা বোলতে পাড়া আর গভীর জ্ঞানের কথা বুঝতে পারা এক জিনিস নয়।
ইতিহাসে দেখা গেছে, যীশু খ্রীষ্টের পুনরাগমনের পর ক্রুসেড এবং অন্যান্য নর হত্যা হয়েছে। এরকম ভয়ংকর হিংসা খ্রিস্টধর্মের নামে ঘটেছে। তাহলে এই সব থেকে প্রশ্ন আসে: পেন্টিকোস্টের রাতে আদৌ কি পবিত্র আত্মার আগমন ঘটেছিলো? নাকি শয়তান এসে মানুষকে যিশুর নামে ভ্রম সৃষ্টি করেছিলো?
এখন বলবেন, ঈশ্বর মানুষকে ভালো মন্দ পছন্দ করার অধিকার দিয়েছে। সত্যিই কি তাই? আপনার বাইবেল আদিপুস্তক খুলে দেখুন—
কিন্তু সাপটা নারীকে বলল, “না, মরবে না। ঈশ্বর জানেন, যদি তোমরা ঐ গাছের ফল খাও তাহলে তোমাদের ভালো আর মন্দের জ্ঞান হবে। আর তোমরা তখন ঈশ্বরের মত হয়ে যাবে!”
(আদিপুস্তক 3:4-5)
এই ভালো মন্দের জ্ঞান কি ঈশ্বরের তরফ থেকে এসেছে? ঈশ্বর তো কখনোই তা চাইতো না মানুষ ভালো মন্দের জ্ঞান গ্রহন করুক। ঈশ্বর মানুষকে জীবন দিয়েছিলো এবং ওই গাছের ফল খেতে বারণ করেছিল। শয়তান ইভা'কে সেই ফল খাওয়ার জন্য প্রেরণা প্রদান করেছিলো। বাইবেলে লেখা আছে — "তখন সেই নারী ও পুরুষ দুজনের মধ্যেই একটা পরিবর্তন ঘটল। যেন তাদের চোখ খুলে গেল আর তারা সব কিছু অন্যভাবে দেখতে শুরু করল। তারা দেখল তাদের কোনও জামাকাপড় নেই। তারা উলঙ্গ। তাই তারা কযেকটা ডুমুরের পাতা জোগাড় করে সেগুলোকে জুড়ে জুড়ে সেলাই করল এবং সেগুলোকে পোশাক হিসেবে পরল।
আদিপুস্তক 3:7
এই Free Will শয়তানের তরফ থেকে শুরু হয়েছে। ওই ফল খেয়েই তাদের চোখ খুলে গেল আর তারা সব কিছু অন্যভাবে দেখতে শুরু করল। তারা দেখল তাদের কোনও জামাকাপড় নেই। তারা উলঙ্গ। খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে কি বিশ্বাসীদের এই লজ্জা বোধ চলে যায়?
তাই আমাদের দেশে নাগা সাধু এবং জৈন সম্প্রদায়ের নগ্ন সাধুদের নিয়ে মন্তব্য করা বন্ধ করা উচিত। এই ধরনের অসঙ্গতিই আমাদের ছেলে মেয়েদের বিভ্রান্ত করে।
যীশু তাঁর শিক্ষা এবং পবিত্র আত্মার ভূমিকা সম্পর্কে যা বলেছেন, তা ছিল শান্তি, ভালোবাসা, এবং আধ্যাত্মিক সত্যের মধ্যে পরিচালিত হওয়া।
যীশু বলেছিলেন:
মথি ৫:৯ —"ধন্য তারা, যারা শান্তি স্থাপন করে, কারণ তারা ঈশ্বরের সন্তান বলে পরিচিত হবে।"
যোহন ১৪:২৭— "আমি তোমাদের শান্তি দিয়ে যাচ্ছি; আমি তোমাদের নিজের শান্তি দিচ্ছি।"
পবিত্র আত্মার দ্বারা অভিষিক্ত হওয়ার পর যীশুর সেই শিক্ষা বিপরীতে কাজ করতে শুরু করে। শয়তান মানুষকে বিভ্রান্ত করতে এবং তাদের সত্য থেকে বিচ্যুত করতে সর্বদা চেষ্টা করে।
বাইবেলে উল্লেখ রয়েছে যে, শয়তান নিজেকে আলো বা পবিত্রতার মতো প্রজ্বলিত করতে পারে (২ করিন্থীয় ১১:১৪)। এই কারণে অনেক সময় শয়তানের প্রভাবকে পবিত্র আত্মার নির্দেশনা হিসেবে ভুল হতে পারে।
যীশু খ্রিস্ট স্বয়ং সতর্ক করেছিলেন যে, মিথ্যা নবী এবং মিথ্যা শিক্ষকেরা তাঁর নামে আসবে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। মথি ২৪:২৪-এ তিনি বলেন, "মিথ্যা খ্রিস্ট এবং মিথ্যা নবীরা দেখা দেবে এবং তারা এমন মহান চিহ্ন ও আশ্চর্য দেখাবে যে, এমনকি নির্বাচিত লোকদেরও সম্ভব হলে বিভ্রান্ত করবে।"
তবে আসল নকল বোঝার উপায়?
হিন্দু ধর্মে শয়তানের কোনো শিক্ষা নেই। কারণ পরমাত্মা নিজের অজান্তে বা জেনে বুঝে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরী করেনি। ঈশ্বর নিজেই নিজের কামনা দ্বারা মায়ার জগত প্রকট করেছেন। সেই মায়ার জগতে নিজের অংশ আত্মাকে জীব রূপে ছেড়ে দিয়ে, তাঁকে মায়ার দ্বারা আবিষ্ট করে, নিত্যলীলা করেছেন। এই জগত তাঁর নাটকের ক্ষেত্র। তিনিই মাতা, পিতা, বন্ধু, শত্রু রূপে ক্রীড়া করছেন।
যদি আমরা যীশুর শিক্ষাকে হিন্দু সনাতন ধর্মের দৃষ্টিতে দেখি। তাহলে এর। সাথে বেদান্তের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। বেদান্ত শিক্ষায় বলা হয়, "আত্মা সর্বজ্ঞ এবং সার্বভৌম" সব জীবের মধ্যে সেই একই চেতনা উপস্থিত।
যীশুর পবিত্র আত্মার বাণীও আধ্যাত্মিকভাবে মানুষের মধ্যে সেই জ্ঞানের আত্মদর্শন হতে পারে, যা আসলে বেদান্তের মূল ধারণার সাথে মিলিত হয়। তিনি বলেছেন "ঈশ্বরের রাজ্য তোমাদের মধ্যে" (লূক ১৭:২১),
যিশুর এই কথা আধ্যাত্মিকতা এবং মানবিক চেতনার গভীর একটি বার্তা বহন করে। বাইবেলের ব্যাখ্যায় ঈশ্বরের রাজ্যের অবস্থানকে বাহ্যিক কিছু নয়, বরং আভ্যন্তরীণ এবং ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা হিসেবে উপস্থাপন করে। এই ভাবনা বেদান্তের মূল ধারার সাথে বিস্ময়করভাবে এক বলে মনে হয়। আত্মার সর্বজ্ঞ এবং সর্বত্র বিদ্যমানতার ধারণা যেন যিশু খ্রিষ্ট ইসরাইলিদের প্রচার করছেন। বেদান্তে বলা হয়, "আত্মানং বিদ্ধি" অর্থাৎ, "নিজেকে জানো," যা আধ্যাত্মিক চেতনার শিখরে পৌঁছানোর প্রতীক।
আত্মা কি অপবিত্র হতে পারে? না হতে পারে না।কারণ, আত্মা অপবিত্র হলে ঈশ্বরের সৃষ্টি অপবিত্র হয়। তাহলে পবিত্র আত্মার দরকার কি? পবিত্র আত্মা আগে থেকেই মনুষের মধ্যে আছে। তা না হলে ঈশ্বরের রাজ্যে যা আমার মধ্যে আছে সেটাও তো দূষিত হয়েছে মনে করতে হবে।
কেবল যীশু খ্রীষ্টই ঈশ্বরের পুত্র এমনটা নয়। আমরা সকলেই ঈশ্বরের পুত্র। আমরা বলতে পারি যে তিনি সকল পুত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
তারা বলেন, "পিতা পুত্র ও পবিত্র আত্মা এক"। ঈশ্বর, আমার মধ্যেই আছেন, তোমার মধ্যেই আছেন। কারণ স্বর্গ রাজ্য কোথাও বাইরে নেই। তাই, হিন্দু ধর্ম দর্শন ও বেদান্ত জানলেই খ্রীষ্টের কঠিন রহস্য যা তিনি বলতে চেয়েছেন, জানতে পারা যাবে। হিন্দু ধর্ম যে কতটা গভীর দর্শন ও জ্ঞানের কথা বলে সেটা আপনি নিচের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হতে পারবেন।
উৎপত্তি:
প্রথমে আমরা আমাদের হিন্দু বৈদিক ধর্ম সম্পর্ক কিছু কথা বলে রাখি। সৃষ্টির আদিতে অনাদি পরমেশ্বর ‘নাদ’ উৎপন্ন করেছিলেন। এই নাদ ওঁ থেকেই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। তাই জগতের নাথ অনাদি।
নাদের আদিতে অ-কার, মধ্যে উ-কার, এবং অন্তে ম -কার যুক্ত হয়ে সাকার ব্রহ্ম রূপে, এক অভিন্ন পরমেশ্বর তিন রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। এই নাদ থেকেই সকল অক্ষর ও তাদের অর্থ এসেছে। বেদের সংস্কৃত মন্ত্র সকল সেই অক্ষর ব্রহ্ম থেকেই এসেছে।
আদিতে যে তিন দেবতার আবির্ভাব হয়েছে তাঁরা হলেন —ব্রহ্মা (অ), বিষ্ণু (উ) এবং মহেশ্বর (ম)। এই তিন দেবতা প্রকট হয়ে জগত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় প্রাপ্তির মাধ্যমে অনন্ত কল্প ধরে পুনঃ পুনঃ জগতের সৃজন, পালন ও সংহার করে আসছেন। তাই অনন্ত কাল ধরে সনাতন ধর্মে সৃষ্টি স্থিতি ও লয় চলে আসছে। যা শুরু হয়েছে , তা একদিন শেষ হবে।
প্রতি কল্পে যখন ব্রহ্মা জগৎ সৃজন করেন, তখন তাঁর দেহ থেকে বিষ্ণু ও মহাদেব প্রকট হন। যখন বিষ্ণু সৃজন করেন তখন তাঁর দেহ থেকে জগৎ ব্রহ্মা ও মহাদেব প্রকট হন। এভাবেই তারা একে অপরের থেকে প্রকট হতে থাকেন। এক থেকে তিন ভিন্ন ভিন্ন রূপেও তাদের 'সৎ-চিৎ-আনন্দ' অর্থাৎ সচ্চিদানন্দ স্বরূপে বলা হয়। কেউ বড় বা ছোটো নয়।
ওই এক ও অদ্বিতীয় সত্ত্বার আসলে কোনো নাম নেই। কারণ নামের সকল অক্ষর তাঁর থেকে এসেছে। আমরা তাঁকে তাঁর বৈশিষ্ট অনুযায়ী সচ্চিদান্দ বলে ডাকি। এই সচ্চিদান্দ আমার ও আপনার সকলের আত্ম স্বরূপ। এক কথায়— ব্রহ্ম।
মাতৃ রূপে তিনিই অভিন্ন, অখন্ড, মঙ্গলময় এবং চরাচরে ব্যাপ্ত। আদ্যাশক্তি মহামায়া যার আশ্রয় করে এই ত্রি-দেবক প্রতি কল্পে সৃষ্টি স্থিতি ও লয় সম্পাদন করছেন। সেই আদি শক্তিকে বলা হয় সচ্চিদান্দ স্বরুপা। তিনি প্রকট হলে এই ত্রিদেব তাঁর সন্তান রূপে প্রকট হন। সচ্চিদান্দ স্বরুপা এই মহামায়াও তারই অভিন্ন সত্তা।
অতএব, তিনি স্ত্রী অথবা পুরুষ নন। উভয় রূপেই তিনি বিদ্যমান। বীজ প্রদানকারী পিতা।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন-পুনরায় আমি তোমাকে সমস্ত জ্ঞানের মধ্যে সর্বোত্তম জ্ঞান সম্বন্ধে বলব, যা জেনে মুনিগণ এই জড় জগৎ থেকে পরম সিদ্ধি লাভ করেছিলেন।
অনুবাদঃ এই জ্ঞান আশ্রয় করলে জীব আমার পরা প্রকৃতি লাভ করে। তখন আর সে সৃষ্টির সময়ে জন্মগ্রহণ করে না এবং প্রলয়কালেও ব্যথিত হয় না।
অনুবাদঃ হে ভারত! প্রকৃতি সংজ্ঞক ব্রহ্ম আমার যোনিস্বরূপ এবং সেই ব্রহ্মে আমি গর্ভাধান করি, যার ফলে সমস্ত জীবের জন্ম হয়।
অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়! সকল যোনিতে যে সমস্ত মূর্তি প্রকাশিত হয়, ব্রহ্মরূপী যোনিই তাদের জননী-স্বরূপা এবং আমি তাদের বীজ প্রদানকারী পিতা।
অনুবাদঃ হে মহাবাহো! জড়া প্রকৃতি থেকে জাত সত্ত্ব, রজ ও তম-এই তিনটি গুণ এই দেহের মধ্যে অবস্থিত অব্যয় জীবকে আবদ্ধ করে।
পাশ্চাত্য ধর্মে ঈশ্বর একজন পুরুষ বা পিতা। আসলে ঈশ্বর স্ত্রী বা পুরুষের ঊর্ধ্বে পূর্ণ ব্রহ্ম পরম পিতা।
মায়া আছে বলেই আমরা তাঁর এই ভিন্নতা বোধ করি। মনে রাখতে হবে, এই ব্রহ্ম তাঁর মায়া থেকে ভিন্ন।এই মায়ার আবরণ সরে গেলে তিনি ও মায়া এক হয়ে যান । তখন দৃশ্য বা ইহা বা (সংস্কৃত: ইদম') এবং আমি বা দ্রষ্টা ( সংস্কৃত: অহম) এর মধ্যে কোনো ভেদ থাকে না। সেই আমি হয়ে যাই। এটাই অদ্বৈতবাদের দর্শন।
দ্বৈতবাদীরা মায়ার অধীন তাই, অদ্বৈত দর্শন তাঁদের কাছে মায়াবাদ নামে পরিচিত। অদ্বৈতবাদ তো মায়ার প্রচার করে না বরং ব্রহ্ম সত্য জাগতিক মায়াকে মিথ্যা বলে।
ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করেননি। এই জগত ঈশ্বরের ইচ্ছায় প্রকট হয়েছে। তিনিই জগত হয়েছেন এবং জগতে বিলীন হয়েও নিজেকে জগৎ থেকে মুক্ত হয়ে কেবল দ্রষ্টা হয়ে বাস করছেন।
আধুনিক বিজ্ঞান ও সনাতন:
সৎ-চিৎ-আনন্দ হলেন সত্য অর্থাৎ, অপরিবর্তনীয়, চেতনাময়, এবং আনন্দ স্বরুপ। প্রতিটি জীবের আসল স্বরুপ হলো এই সৎ-চিৎ-আনন্দ স্বরুপ। তাই প্রতিটি জীবের মধ্যে বেচেঁ থাকার ইচ্ছা, চেতনা ও আনন্দ ভোগের ইচ্ছা আছে। এমনকি জগতের জড় পদার্থের মধ্যেও নিজেকে টিকিয়ে রাখার গুণ আছে।
উদ্ভিদের সেই চিৎ শক্তি না থাকলে তার মধ্যে অভিযোজনের ক্ষমতা থাকতো না। চিৎ শক্তি কাজ করছে বলেই অনু পরমাণুর মধ্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার গুণ দেখা যায়। সেই কারনেই ওই অনু পরমাণুর দ্বারা জীব বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে।
পদার্থ বিজ্ঞান শুধু সেই অনু পরমাণুর গুণ সমুহ বিচার করে আমাদের বলতে পারে। অমুক পরমাণুর ইলেকট্রন গুলো নিকটবর্তী সুস্থির পরমাণুর ইলেকট্রন যোজ্যতায় সুস্থির হওয়ার জন্য অমুক পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তমুক মৌল গঠন করে।
অস্থির পরমাণুর ইলেকট্রন তার নিকট সুস্থির যোজ্যতায় থাকা পরমাণুর যোজ্যতা লাভের যে কারণ। সেটা কেন হচ্ছে, বিজ্ঞান তা বলতে পারতো না। “কেন হচ্ছে?”, এই প্রশ্নের শেষ নাই। ,
কেন হচ্ছে?”, এই প্রশ্নের উওর খুঁজতেই, বিজ্ঞানীদের গণনা ধারনা পরমাণুর ভেতরে ঢুকে আধুনিক কোয়ান্টাম থিওরির ভাবনা এসেছে।
এই কোয়ান্টাম থিওরির সূত্র ধরে বৈজ্ঞানীক ও থিওলজিস্টরা হিগস বোসনের থিওরী, স্ট্রিং থিওরী’র দিকে এগিয়ে গেলো। বলা হলো, সকল পরমাণু এবং অন্তঃপরমাণবিক শক্তি গুলো এই স্ট্রিং নামক কম্পমান ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ দ্বারা গঠিত।
এই ভাবেই বিজ্ঞান ধিরে ধিরে সূক্ষ থেকে সূক্ষতর জ্ঞানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এবং অনেক বিজ্ঞানী universal consciousness কে স্বীকার করেছেন।
এই মত অনুসারে এই ব্রহ্মাণ্ড একটি বিশাল সুপার কম্পিউটারের মতো কাজ করে। কোনো এক জায়গায় কোনো ছোটো পরিবর্তন হলে, তার প্রভাব সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে যায় এবং সেটাকে সঠিক করার জন্য সমগ্র বিশ্ব থেকে অনেক গুলো সম্ভাবনা কাজ করতে থাকে। আমরা যা কিছুই দেখি কিছুই সত্য নয়। স্তরে স্তরে এগুলো একটা সিমুলেশন।
এটাই তো হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে বলছে। universal consciousness আমাদের সনাতনী শাস্ত্র চিৎ শক্তি বলেছে। পার্থক্য শুধু একটাই শাস্ত্রে শুধু কমেন্ট্রি আছে বিজ্ঞান সেটা গাণিতিক সমীকরণ দিয়ে পুষ্ট করেছে।
যদি কেউ বলে ধর্মগুলো তৈরি হয়েছে অন্ধবিশ্বাস থেকে, এবং বিজ্ঞান পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং ক্রমাগত অনুসন্ধানের মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। আমি তাদের প্রশ্ন করতে চাই। যখন ডালটন তার পরমাণুবাদ তত্ত্বটি দিয়েছিলেন। তখন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ সেটাকেই সত্য বলেই গ্রহণ করেছিল, ডালটনের পরমাণুবাদকে অন্ধভাবেই বিশ্বাস করেছিল। পাঠ্যপুস্তকে সেই ডাল্টনের পরমাণুবাদকেই পড়ানো হয়েছে। ম্যাক্সওয়েল, প্ল্যাঙ্ক প্রভৃতি বৈজ্ঞানিকরা যখন আধুনিক পরমাণুবাদ স্থাপন করলেন। তখন মানুষ জানলো পরমাণু শুধু ইলেকট্রন প্রোটন দিয়ে তৈরি নয়। তাঁর থেকেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অন্ত:অনবিক পদার্থ আছে। এর পর, ফোটন, পজিট্রন, গ্রাভিট্রন, এন্টিম্যাটার ইত্যাদি আবিষ্কার হোলো।
তাহলে বলুন, বিজ্ঞানে কি এক সময়ে তাঁদের নিজেদের গবেষকদের কথাকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করেনি? তবে ধর্ম কেন অন্ধ বিশ্বাসের বোঝা টানবে?
প্রাথমিক অবস্থায় কোনো সত্যে পৌঁছাতে গেলে আমাদের বিশ্বাস করেই এগোতে হয়। পৌঁছানোর পরই বলা যাবে, সত্যটা আসলে কি! তাই আমি বোলতে পরি, হিন্দু ধর্ম খুবই যুক্তিশীল এবং বৈজ্ঞানিক ধর্ম।
জীব এবং জগত:
হিন্দু ধর্ম অনুসারে, ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আগে সাচ্চিদানন্দ নিজ মায়ার সঙ্গে এক ছিলেন। তিনি মায়া বিস্তার করে খিরদ সাগর তৈরী করলেন। সেই সগরের জলকে নার বলা হয়েছে। ওই 'নার' নমক জলে নারায়ণ প্রকট হলেন। নারায়ণের প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাসের হাজার হাজার ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়। আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ড তারই মধ্যে একটি। প্রতিটি ব্রহ্মাণ্ডে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়কর্তা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এই তিন দেবতা থাকেন।
প্রথম কল্পে ভগবান বিষ্ণু তাঁর নাভি কমল থেকে নিজের স্বরূপে সৃষ্টি কর্তা ব্রহ্মার উৎপত্তি করেন। সেই ব্রহ্মদেব হাজার বছর তপস্যা করে জগত সৃষ্টি করে। সত্য, দ্বাপর, ত্রেতা ও কলি এই তিন যুগ অতিবাহিত হলে মহেশ্বরে সব লয় পায়। তখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর এক হয়ে মহাকালের রূপ ধারণ করবে। সব কিছু গ্রাস করে পুনরায় সৃষ্টির নতুন পর্যায় শুরু হবে।
প্রজাপিতা ব্রহ্মা যিনি সৃষ্টিকর্তা, তাহার দেহ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সয়াম্ভু মনু ও শতরূপা সৃষ্টি হয়েছে। সেই সয়ম্ভু মনুর নয় জন মানসপুত্র (মারিচ, অত্রি, অঙ্গীরা, পুলহ, পুলাস্ত, কৃতু, বশিষ্ট, ভৃগু এবং কশ্যপ)। মনু সেই সাত পুত্রের মধ্যে একজন ছিলেন ঋষি কশ্যপ। ঋষি কশ্যপের স্ত্রী দীতি ও অদীতির গর্ভ থেকে জন্ম হয়েছে দেবতা, দানব, আসুর, মানব, নাগ, সর্প, অন্ডজ, স্বেদজ জীব এবং কিট। তাই দেবতা থেকে কিট, সকলেই আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। মানুষ ছাড়া সকল জীবকুল অজ্ঞ। দেবতারাও বদ্ধ। তাই, কেবল মানুষ মুক্তি বা মোক্ষ লাভ করতে পারে।
মুক্তির পথ সদগুরুর হাত ধরে হয়। গুরুর সঙ্গে জুড়ে থাকার জন্য দীক্ষা গ্রহণ করা আবশ্যক। গুরুই সকলের পাপ ক্ষমা করে, গুরুই বিচারক, গুরুই ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। এক শরীরে তিনি সব। গুরুই সাক্ষাৎ পরমেশ্বর। শক্তি যার বাম কোলে, মুক্তি তাহার আজ্ঞা। আদি গুরুর প্রতিরুপে, তিনি একমাত্র রাস্তা। তাই, শ্রীকৃষ্ণও গুরু করেছেন ঋষি সন্দীপনকে। শ্রী রামচন্দ্রের গুরু ছিলেন ঋষি বশিষ্ঠ। ঋষি বশিষ্ঠের কোনো গুরু ছিল দেবাদীদেব শিব। বশিষ্ঠ ভগবান মনুর মানসপুত্র ছিলেন।
বর্ণ ও জাতি:
সৃষ্টির আদি ভাগে কোনো বর্ণ ছিলো না। সকলেই ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মন ছিলেন। ঋষিরদের পুত্রদের পিতৃ বলা হয়। সেই পিতৃ বা পিতরদের নাম কব, হবিস্মন্ত, আজপা ও সুকালিন। এরা ক্রমশ ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয় বৈশ্য ও শূদ্রের পিতৃপুরুষ। হবিস্মন্ত এবং আজপার সন্তানরা আমোদ-প্রমোদ, হিংসা-নিন্দা, ক্রোধ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় তারা ব্রাহ্মণত্ব চ্যুত হয়েছিল। সুকালিনের সন্তান আলস্য, নিদ্রা, আকর্মন্যতার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে শুদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছিল । এই থেকেই চার বর্ণের শ্রেণী উৎপন্ন হয়েছে।
এই বর্ণ গুলো একত্রে ইশ্বরের দেহ তৈরী করে, অর্থাৎ সমাজ রুপে ইশ্বরের দেহ তৈরী করে। বেদের জ্ঞান, পবিত্রতা ও শক্তি বজায় রাখার স্বার্থে প্রত্যেক বর্ণে জন্য সংস্কার ও অধিকার নির্দেশ করা হলো। এই সংস্কার থেকেই আর্য জাতির উদ্ভব হোলো। আর্য সংস্কার চ্যুত অনার্যদের ম্লেচ্ছ, শক, হুন, যবন, পারখ(পারস্য), ইত্যাদি জাতির কথা আমরা পাই।
মূলত প্রাচীন কালে মিশরীয় সভ্যতার জনগোষ্ঠীকে ম্লেচ্ছ বলা হতো আর পরবর্তিতে ইহুদীদের কেও ম্লেচ্ছ বলা হতো। এই ইহুদিদের জাতীয় পতাকায় যে The hexagram বা ষঠকোণ বিশিষ্ঠ যে দুই ত্রিভুজ অঙ্কিত আছে। যাকে ডেভিডের মোহর বলা হয়। যার অর্থ “যা দেওয়া হয়েছে ফেরত নেওয়া হবে”।
খ্রিস্টানরা ওটাকে শয়তানেরা চিহ্ন বলে। ওই চিহ্ন হিন্দুরাও তন্ত্রে বিভিন্ন শক্তিযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। হিন্দু মতে সেটি প্রকৃতি ও পূরুষের মিলন। এই প্রসঙ্গে আমরা এখনো আলোচনা করছিনা। পরবর্তীতে সেই বিষয় আলোচনা করা হবে। এখন আমরা ১৬ বিধ সংস্কার সম্পর্কে জানবো।
সংস্কার:
সংস্কার ছাড়া কোনো মানুষ সু-সংস্কৃত হতে পারে না। সংস্কার প্রাপ্ত না হলে কু-সংস্কার বৃদ্ধি পায় এবং সমাজে সেচ্ছাচার বৃদ্ধি পায়। যার ফলে কলহ উৎপন্ন হয়। সমাজকে এক সূত্রে বাধার জন্য আর্য ঋষিরা ১৬ প্রকার সংস্কার প্রণয়ন করেছেন। যথা:— গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন, জাতকর্ম, নামকরণ, নিষ্ক্রমণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, কর্ণভেদ, বিদ্যারম্ভ, উপনয়ন, বেদারম্ভ, কেশান্ত ও ঋতুশুদ্ধি, সমাবর্তন, বিবাহ ও অন্ত্যেষ্টি। এই ১৬ সংস্কারের মধ্যে কিছু কিছু সংস্কার হিন্দু সমাজে গ্রহন করা হয়। এই সংস্কার গুলো বৈদিক সংস্কার। এছাড়াও তান্ত্রিক সংস্কার আছে। তবে সুগুলো সর্ব সাধারণের জন্য নয়। খ্রিষ্টানদের (রোমান ক্যাথলিক) -দের মধ্যেও এমন ৭ প্রকার সংস্কার (বা Sacrament) আছে। যার দ্বারা তাদের উদ্ধার হয়। ইসলাম ধর্মে সংস্কার-কে সুন্নত বলা হয়।
পাপ-পূণ্য, পুনর্জন্ম ও পরলোক:
স্বর্গ-নরক আছে কি নেই এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তবে আপ্ত বাক্য এবং শ্রুতি প্রমাণ বলা আছে। হিন্দু ধর্ম অনুসারে প্রত্যেক জীব নিষ্পাপ হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নেয়। জন্মের পর সে 16 বছর পর্যন্ত যে সকল পাপ করে তার কোনো ফল ভোগ করতে হয় না। 16 বছর পর যে সকল পাপ হয়, সে তাহা ভোগ করে। হিন্দু ধর্মের এমন কোনো বিধান নেই যে, বেদ না মানলে বা অমুক দেবতা না মানলে অনন্ত কাল ধরে নরকের যাতনা সে ভোগ করবে। সব পাপের ক্ষমা হয় জীবন কালেই প্রায়শ্চিত্ত ও পাপ স্বীকার দ্বারা। ইশ্বর এই দয়া টুকু মানুষকে করেছেন। অর্থাৎ, তুমি কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম পুস্তক মেনে চলো বা না চলো, ইশ্বরকে মানো অথবা না মানো। এতে তুমি পাপের ভোগী হবে না। কর্মের ফল সকলকে ভোগ করতে হবে। প্রায়শ্চিত্ত ও পাপ স্বীকার করলে কেবল মাত্র পাপের বোঝা কমে যাবে। যেখানে পা ভাঙার যোগ থাকবে, সেখানে পায়ে সামান্য চোট দিয়েই চলে যাবে। এই হলো কৃপা।
ছোটো ছোটো শিশু অনেক সময় মারা যায়, জন্ম থেকে তাকে শারীরিক কষ্ট ভোগ করতে হয়। সে তো পাপ পুণ্য বোঝে না, কোনো কর্মই করেনি। এমন শিশুর দুর্ভোগ কেন? হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে এর উত্তর হোলো পূর্ব জন্মের সঞ্চিত কর্ম বা প্রারব্ধ। পূর্ব জন্মের স্মৃতি লুপ্ত হয়ে নতুন জন্ম প্রাপ্ত হয়। কিন্তু সংস্কার লুপ্ত হয় না। সেই জন্যে একই মায়ের পেটে জমজ ভাই একই আদর, একই শিক্ষা পেয়েও আলাদা আলাদা চরিত্রের হয়। এটাও প্রামণ পুনর্জন্ম হয়। মৃত্যুর পর আত্মার কোনো পরিবর্তন হয় না, জীবের কর্ম ও সংস্কার নতুন গর্ভে রূপ ধারণ করে।
হিন্দু ধর্মে এটাও বলা হয়েছে ৬৪ লাখ যোনীর মধ্যে মানুষ যোনী সর্ব উৎকৃষ্ট। কারণ কেবল মানুষ যোনীতে জীব ইশ্বরকে আরাধনা করে। অন্য সকল যোনী কেবমাত্র ভোগ করার জন্য তৈরী। দেব যোনীও ভোগ যোনী।
ইশ্বরের প্রেম:
কর্ম এক প্রকার বীজ। যার ফলকে প্রারব্ধ বলা হয়। প্রারব্ধ কেউ আটকাতে পারে না। যেমন, ইশ পুত্র যিশু খ্রিস্টের ক্রুশে জীবন দান এবং ভগবান শ্রী কৃষ্ণের পায়ে তির বিদ্ধ হয়ে প্রাণ ত্যাগ। এই সবই প্রারব্ধ ছিলো। পায়ে তির বিদ্ধ হয়ে কেউ কি মারা যায়? যিনি অন্ধকে চোখ দান করে, রোগীকে সুস্থ করে। সে কি পারতো না নিজেকে বাঁচাতে? কিন্তু এসবই পূর্ব নির্ধারিত প্রারব্ধ। খ্রীষ্ট নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন ওই ভবিষ্যত বাণীকে পূর্ণ করার জন্য যা ইশ্বর তাঁকে বলেছিল (যোহন 17:2-6)। এরপর যিশু খ্রিস্ট বলেছেন: “আমি তাদের জন্য এখন প্রার্থনা করছি৷ আমি সারা জগতের জন্য প্রার্থনা করছি না, কেবল সেই সকল লোকদের জন্য প্রার্থনা করছি যাদের তুমি দিয়েছ, কারণ তারা তোমার।” (যোহন 17:9) —এটি ছিলো ইহুদী জাতির জন্য। যিশু খ্রিস্ট নিজে একজন ইহুদী ছিলেন তাই তিনি যা কিছু বলে গেছেন, তাই সেটা ইহুদী জাতির জন্য ছিলো। আমরা সনাতনী হিন্দু। যিশু খ্রিস্টের কথার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তাঁর সেই বলিদানকে আমরা সন্মান করি।
যিশু খ্রিস্টর পিতা ও পবিত্র আত্মাকে হিন্দু ধর্মের দৃষ্টিতে অবলোকন।
খ্রীষ্ট ভক্তরা যীশু খ্রীষ্ট কে ঈশ্বর মনে করেন। যিনি কুমারী মাতা মেরির গর্ভে অযৌন পদ্ধতিতে অবতারিত হয়েছিলেন। যীশু একজন ইহুদি ছিলেন এবং শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে দৈব গুণের প্রকাশ ছিলো। তার ব্যাখ্যায় ইহুদি বিদ্বানরা মুগ্ধ হয়ে যেতেন। জর্ডন নদীতে জোহন দ্বারা বপ্তিস্মা নেওয়ার পর তিনি আশ্চর্য কাজ শুরু করেন। তাঁর এই আশ্চর্যের কাজ দেখে ইহুদি পুরোহিতরা ঈর্ষা করতে শুরু করেন এবং ষড়যন্ত্র করে তাঁর হত্যা করা হয়। মৃত্যুর তিন দিন পর তিনি আবার জীবিত হয়ে ওঠেন। এবং ইহুদিদের ধর্মীয় পুস্তকে উল্লেখ্য করা ভবিষ্যত বাণীকে পূর্ণ করেন। এরপর তিনি তাঁর বারোজন শিষ্যকে বার্তা বহনের আদেশ দিয়ে ঊর্ধ্বলোকে গমন করেন।
ইহুদী জাতি হিন্দু থেকেই আগত। বেদ মার্গ ত্যাগ করে তারা ম্লেচ্ছ হয়েছে। এই ইহুদি সম্প্রদায় পূর্বে জরস্ট্রিয়ান ধর্ম সম্প্রদায় ভক্ত ছিল। পরবর্তীতে মিশর, ইরান, ইসরাইলের দিকে প্রসারিত হয়। মেরুতন্ত্র নামক শাস্ত্রে বিভিন্ন জাতি, ও তাদের আধ্যাত্মিক বিভাজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পারখ, ফারসি জাতির উল্লেখ করা হয়েছে। বিস্তারিত জানতে পড়ুন
এই ইহুদীদের পূর্ব-পুরুষ গ্রীক ও মিশরে বসবাস করতো। পরবর্তী সময়ে তারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রীক ও মিশরের দেবী দেবতাদের হিন্দু দেবী দেবতাদের মতোই পৌরাণিক কাহিনী আছে। জিউস ও ইন্দ্র একই রকম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। আমরা মিশরের দিকে যদি এগিয়ে যাই, সেখানে দেখতে পাই ফ্যারাওরা নিজেদের ইশ্বর বলতে শুরু করেছিল। তন্ত্রশাস্ত্রে এর উল্লেখ আছে।
খ্রীষ্ট ভক্তরা যখন প্রচারে আসে। তারা বলেন, আমাদের ইশ্বর জীবিত ইশ্বর। তিনি নিজের জীবন দিয়ে সকলের পাপ ক্ষমা করেছেন। এতটুকু আমরা স্বদরে গ্রহন করি। কিন্তু যখন তারা বলতে শুরু করে, "তোমাদের ইশ্বর দেবতারা ব্যভিচার ও লড়াই করেছে"। তখন হিন্দুরা দুঃখ পায়। হিন্দুরা নিজের ধর্ম সম্পর্কে সামান্য কিছুই জানে না না । তাই তারা চুপ করে থাকে। খ্রীষ্ট ভক্তদের মত অনুসারে তাদের ইশ্বর একজন জীবিত ইশ্বর এবং পাপের ক্ষমা করতে পারেন। হিন্দুদের মনে প্রশ্ন জাগে, তবে আমাদের ইশ্বর কি মৃত? আমাদের ইশ্বরের কি সেই ক্ষমতা নেই? খ্রিষ্টানরা নিজের ধর্ম ছাড়াও অন্য ধর্মের অনুশীলন করে। আর আমরা তো কীর্তন, বাদ্য বাজিয়ে মাতোয়ারা হয়ে ইশ্বরকেই এক কোনায় ঠেলে রাখি। আমরা জানি না আমাদের ইশ্বর আসলে কে, তিনি আমাদের জন্য কি করেছেন। তবে যেনে রাখুন :—
যীশু যাকে পিতা বলেন, তিনি আর কেউ নন সয়ং সচ্চিদান্দ সদাশিব। এখন প্রশ্ন হলো সদাশিব কে? উত্তর এই প্রকার বোঝার চেষ্টা করুন— কৃষ্ণ নিজের যে বিরাট রূপ অর্জুনকে দেখিয়ে ছিলেন সেই বিরাট রূপের যে মহাকাল রূপ যিনি সমগ্র জগত গ্রাস করছিলেন, সেই পঞ্চ মস্তকধারী শিবই হলেন সদা শিব। এই একই রূপকে শাক্ত, বৈষ্ণবরা পরমাপ্রকৃতি, ব্রহ্ম স্বরূপিনী, পরমাত্মা, ইত্যাদি নামে ও রূপে স্মরণ করে। যোগীগন একেই আত্মা বলেন।
খ্রীষ্ট ভক্তরা না জেনেই ওই শিব তত্ত্বের আরাধনা করেন। শিব পুরাণ ও বিষ্ণু পূরণে আছে বিষ্ণু ও শিব একই। একই পয়সার এপিঠ ও পিঠ। আমি শিব বললাম কারণ এতে বোঝাতে সুবিধা হবে।
এবার শুনুন, খ্রীষ্ট যেই পবিত্র আত্মার বলে বিভিন্ন চমৎকার করেন, তিনি হলেন আদ্যা শক্তি মহামায়া। এই মায়ার সংসারে মায়ার দাড়াই কাজ করে। এই মায়া কে? আমাদের যেমন মন আছে, ইশ্বরের তেমন মায়া। সেই শক্তিকে আয়ত্ত্ব করতে হলে ঈশ্বরই হতে হয়। তাই যিশুও ইহুদীদের মুক্তি দাতা ইশ্বর ছিলেন। তিনি ইহুদি জাতিকে উদ্ধার করতে পৃথিবীতে এসেছিলেন।
ইশ্বর আমাদের জন্য কি করেছে?
ইশ্বর কী আমাদের উদ্ধারের জন্য তাঁর একমাত্র পুত্রকে বা নিজেকে বলি দিয়েছেন? তিনি কি তাঁর শেষ নবীকে পাঠিয়ে কাফের বা মুমিনদের ভাগ কোরেছেন?
না, ইশ্বর এসব কিছুই করেননি। তিনি নিজের স্বরূপকে আমাদের মনের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছেন। তিনি কাফের মধ্যেও আছেন আবার মুমিনদের মধ্যেও আছেন। তিনিই পুত্র হয়ে বলিদান দিয়েছেন আবার তিনি বলি দাতা হয়ে বলি গ্রহন করেছেন। কারণ সব কিছুই তিনিই পরিচালনা করেন। তাই, হিন্দু ধর্মের গভীরতা সব থেকে বেশী।
তিনি আমাদের তাঁর (গীতায় যে) জ্ঞান দিয়েছেন। যার দ্বারা আমরা তাঁকে জেনে নিজেরাই পাপ থেকে মুক্ত হতে পারি। তিনি আমাদের জন্য পুনর্জন্মের ব্যবস্থা করেছেন। যাতে আমাদের মত অজ্ঞ জীব পুনঃ পুনঃ জন্ম গ্রহন করে নিজেকে বার বার উন্নত থেকে উন্নত করতে পারেন। তিনি তাঁর আশ্রিত এবং অনাশ্রিতদের মধ্যে ভেদভাব করেননি।
তিনি প্রত্যেক মানুষকে বিবেক দিয়েছেন, ভালো ও মন্দের বিচার করার জন্য। তিনি প্রত্যেক মানুষকে চিত্ত ও মন দিয়েছেন চিন্তন ও মনন করার জন্য।
এই দেহ, এই ইন্দ্রিয় তো ভোগের যন্ত্র নয়, যোগের যন্ত্র। তিনি এতটা দয়ালু যে যোগের পথে বিফল হলে, তন্ত্র পথে তাঁর কাছে পৌঁছানো যায়। তিনি মন্দকে ঘৃণা করতে বলেনি। তিনি বলেছেন, মন্দকে জেনে তা থেকে দূরে থাকতে। এমনকি মন্দ থেকেও ভালোকে গ্রহন করতে।
ঈশ্বর কোনো ভুল করেনা বা তাঁর নিজের সৃষ্টিকে তিনি অবহেলা করে ধ্বংস করেন না। তিনি লীলাধর, তিনি মায়াধর, তিনি মায়ার লীলা করেন।
রাবনকে আমরা মন্দ বলি, কারণ শ্রী রামকে আমরা ইশ্বরের অবতার মনে করি। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত রাবণ যখন নিজের শেষ নিশ্বাস নিচ্ছিল, শ্রী রাম তাঁর ভাই লক্ষণকে রাবনের কাছে রাজনীতির জ্ঞান নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিল। আবার এই রাবণ তাঁরই নিত্য ধামের পার্ষদ যার নাম ছিল জয়।
পায়ে তির বিদ্ধ হয়ে কেউ কি মারা যায়? এসবই তাঁর ছলনা। ভগবান শ্রী কৃষ্ণ প্রাণ ত্যাগের লীলা করে গেছেন। রানী গান্ধারী তার সন্তান শত সন্তান হারানোর পর পুত্র হারানোর আবেশে ভগবান শ্রী কৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, তার যদু ধ্বংশ হবে, কুরু বংশের মতোই যদু কুল শশানে পরিণত হবে।
গান্ধারীর আক্ষেপ ছিলো, চাইলে শ্রী কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থামাতে পারতেন। সেখানে শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করতে উপদেশ দিয়ে ছিলো। আমরা দেখতে পাই, যুদ্ধের আগে শ্রী কৃষ্ণ নিজেই শান্তি দূত হয়ে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন।
রাজা ধৃতরাষ্ট্র যদি শুধু ৫টা গ্রাম পাণ্ডবদের দিতেন, দুর্যোধন যদি শ্রী কৃষ্ণকে অপমান না করে তাড়িয়ে দিতেন। তাহলেই এই যুদ্ধ আটকানো যেতো। সব দোষ রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর পুত্র দুর্যোধনের। শ্রী কৃষ্ণের কোনো দোষ ছিলো না। তা সত্বেও শ্রী কৃষ্ণ মাতা গান্ধারীর অভিশাপ গ্রহন করে আত্ম বলিদান দিয়েছেন।
যে বেধের তীর বিদ্ধ হয়ে তিনি জীবন দিয়েছেন, সেই বেধকে তিনি আশির্বাদ করে গেছেন। এমন উত্তম উদারণ থাকতে আমরা কেন ইহুদিদের বা অন্য ইশ্বরকে গ্রহন করবো?
এসব কথা আমি এই কারনেই বলছি কারণ মানুষ শুধু নিজ ধর্ম মতকে সব থেকে বেশি প্রাধান্য দেয়। সব ধর্মমত গুলো নিজেকে বড় করে দেখায়। হিন্দু ধর্মেই শৈব, স্মার্ত, শাক্ত, বৈষ্ণ পরস্পরের বিরুদ্ধে কথা বলে।
ইসলামে সিয়া, সুন্নি, আহমদিয়া পরস্পরের বিরুদ্ধে কথা বলে। খ্রীষ্ট ধর্মে প্রটিষ্ঠান, কেথলিক, অর্থডক্স নিজেদের মধ্যে বিবাদ করে।
ধর্মের উদ্দেশ্য হলো ইশ্বরের সত্যতা প্রকট করা। সেটা প্রত্যেকেই করছে কিন্তু নিজ নিজ বুদ্ধি ও বিবেক দ্বারা নিজের মতো করে। এর মধ্যে কোনটা কতটা সঠিক কতটা ভুল বলা মুশকিল। এটি নির্ণয় করা— খড়ের গাদায় সুই খোঁজার মতো কঠিন।
হিন্দু ধর্ম বলে ইশ্বর কখনোই insecure বা jealous হয় না। সব কিছুই যখন তাঁর হাতে, সব কিছুই যখন তার থেকেই এসেছে, তবে ঈর্ষা কেন করবেন? খ্রিস্টান ধর্মের ঈশ্বর jealous করে অর্থাৎ তিনি আসল ঈশ্বর নন।
ইশ্বর যদি নিজেই নিজের সৃষ্টিকে নিয়ে insecure বা Jealous অনুভব করে, তবে ওই ইশ্বরের সৃষ্টিতে insecureness বা jealousy করার মতো কোনো লুসিফারের দরকার নেই। সে ঈশ্বর নিজেই শয়তান মেনে নিতে হবে। ঈশ্বর সব সময় পূর্ণ এবং নির্লিপ্ত।
আমাদের ধর্মে ইশ্বর লীলাধর ও মায়াধর তিনি নিজেই নিজের দ্বারপাল (geat keeper) -দের নিজের শত্রু বানিয়ে, মায়া সৃষ্টি করে, নিজের সঙ্গেই লীলা করেন। যেভাবে ফুটবল খেলার মাঠে একই ক্লাসের বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে দল বানিয়ে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। খেলার শেষে সবাই একসাথে আনন্দ করে টিফিন ভাগ করে খায়। সেভাবেই হিন্দুদের ঈশ্বর নিজের সৃষ্ট জগতে নিজেই নিজের পর্ষদদের নিয়ে লীলা করেন। আবার এই পর্ষদ গুলোও তো তাঁরই রূপ, তাঁরই বিভূতি।
তাই আমাদের মনে রাখা উচিত যীশু, মোহম্মদ, বুদ্ধ, মহাবীর, সকলেই ওই ঈশ্বরের পর্ষদ। তাই, কারো প্রতি, কোনো ধর্মের প্রতি আমাদের কোনো আন্তরিক বিদ্বেষ পোষণ করা উচিৎ নয়। যা আমার পথে বাধা তাঁকে উপেক্ষা করা উচিত।
0 Comments: