Headlines
Loading...
সনাতন ধর্মের 'গুরুপ্রসাদী' প্রথা সম্পর্কে অপবাদ।

সনাতন ধর্মের 'গুরুপ্রসাদী' প্রথা সম্পর্কে অপবাদ।

গুরুপ্রসাদী বলে আদৌ কোনো প্রথা ছিল না। ইহা কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত একটি কাল্পনিক কাহিনীর ঘটনা মাত্র। কালীপ্রসন্ন সিংহ ডিরেজিওর ইয়ং ইন্ডিয়ান সোসাইটির একজন সদস্য ছিলেন। ডিরেজিও নিঃসন্দেহে তাঁর সমাজ সংস্কারের চেষ্টাকে একপাক্ষিকভাবে ভালো বা খারাপ বলা কঠিন। যদিও তিনি শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁর কিছু উগ্রপন্থী কার্যকলাপ সমাজে ব্যাকফায়ার করেছিল এবং হিন্দু সমাজের মূলধারায় সেটি গ্রহণযোগ্য হয়নি। এ কারণেই, তাঁর আন্দোলন এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে।


 ডিরেজিওর ইয়ং ইন্ডিয়ান সোসাইটির অনুপ্রেরণায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে যুবকদের মধ্যে একরকম আন্দোলন শুরু হয়। সেই কাল খন্ডে এরকম বহু ‘পরিভাষা’ বা terminology উদ্ভব হয়। যা ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতো। যেমন কিছু উদাহরণ

  1.  "ধর্মান্ধ" ও "গোঁড়া" (Bigot/Fanatic)", 
  2. ব্রাহ্মণ্যবাদ" (Brahminism), 
  3. "দাসমন" (Slave Mentality), 
  4. "বিপ্লবী" (Revolutionary),
  5.  ভাষ্করপন্থী (Bhaskarites)
  6.  নবযুগীয় (Neo-Ageists)
  7. ধর্মপাল 
  8. হিন্দু মোল্লা
  9. মুর্খ বেদান্তী
  10.  কালা পাদ্রী (Black Padre)
  11. আধুনিক বানরসেনা
  12. ফ্রিথিংকার (Freethinker)
  13. কুসংস্কারাচ্ছন্ন (Superstitious)
  14. ব্রাহ্মণ্যবাদী(Brahminical)
  15. সংস্কারবদ্ধ (Orthodox)

গুরুপ্রসাদী এরকমই একটি পরিভাষা। যার পেছনে কোনো শাস্ত্রীয় সত্যতা বা প্রমাণ নেই বরং এটি একটি নিছক অপবাদ। শ্রীকৃষ্ণের গোপিভাব কে শিষ্যের ভক্তি ভাবের সঙ্গে প্রস্তুত করতে যে শ্লোক লেখা হয়েছিল। তাহাই বিকৃত রূপ দিয়ে "গুরু প্রসাদী" নামে প্রচার করা হতো।

ঠিক একই শ্লোকটি মহারাজ লাইবেল কেস (Maharaja Libel Case ) হয়েছিল। একুশ অক্টোবর 1860 খ্রিস্টাব্দে কর্ষণ দাস মুন্সি জী তার "সত্য প্রকাশ"  খবরের কাগজে একটি প্রতিবেদন লেখেন। যার শিরোনাম ছিল, "হিন্দুদের আসল ধর্ম এবং বর্তমানের ভন্ড সম্প্রদায়।" পুষ্টি মার্গি বল্লভাচার্যের  পৌত্র গোকুল নাথজীর টিকা কে  

 এই অপবাদ অনুসারে, "বিয়ের পর স্ত্রীর সাথে সহবাস করার আগেই গুরুদেবের কাছে নিজের স্ত্রীকে নিবেদন করতে হতো। গুরুর নব বধূর সাথে সহবাস করা হয়ে গেলে তার প্রসাদ পেতেন শিষ্য, তাই এই প্রথার নাম হল গুরুপ্রসাদী।" 

ঊনবিংশ শতাব্দীর এক লেখক কালিপ্রসন্ন সিংহের  'হুতোম প্যাঁচার নকশা' বইয়ে এইরকম ঘটনার বিবরণ মেলে। লেখক কালিপ্রসন্ন চৈতন্যচরিতামৃত থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন 


যিনি গুরু তিনি কৃষ্ণ না ভাবিও আন্
গুরু তুষ্ঠে কৃষ্ণ তুষ্ট জানিবা প্রমাণ।
প্রেম আরাধ্য রাধা সমা তুমি লো যুবতী।
রাখ লো গুরুর মান যা হয় যুক ্তি।

যিনি গুরু তাঁকে কৃষ্ণ ছাড়া অন্য কিছু ভেবনা। গুরু তুষ্ট হলেই কৃষ্ণ তুষ্ট হন এই জানিও। হে যুবতী গণ, প্রেমের মাধ্যমে আরাধনা করলে রাধার মতো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় একাকার হওয়া সম্ভব। যে কোনো পরিস্থিতিতেই গুরুর সম্মান রক্ষা করো, কারণ তা যুক্তিসঙ্গত ও শাস্ত্রসম্মত।

এখানে গুরুর সঙ্গে ভক্তির রসের সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে উপরন্তু "রাখ লো গুরুর মান" অর্থাৎ "গুরুর সম্মান রক্ষা করো" বলা হয়েছে। কালীপ্রসন্নের মতো শিক্ষিত লোকেরা কোথায় যৌনতা খুঁজে পায়? এটাই সভ্য সমাজের লোকেদের কাছে আমার প্রশ্ন? 

নিজের চরিতার্থ পূরণের জন্য তিনি গুরুপ্রসাদী প্রথার কথা লিখেছেন। যেখানে নব্যবিবাহিতা স্ত্রী কে গুরুকে না দিয়ে তাঁর শিষ্য নব বধূকে গ্রহণ করতে পারবে না। এবং এই কালি প্রসন্ন ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে একজন গুরু এক কন্যাকে বিছানায় নিয়ে গেলেন এবং *****(ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়)। 

Doubt of benefit এর খাতিরে যদি মেনেও নেওয়া হয়। এরকম ঘটনা ঘটেছে। তবে কি তখনকার হিন্দু সমামাজ এইসব ও কর্মের সহমতি দিয়েছিল? আমরা জানি একই জাতের মধ্যে জাত শত্রু থাকে। কোনো ধর্মগুরু ভুল শিক্ষা বা উদ্ধৃতি দিলে, ঈর্ষান্বিত বাকি ধর্মগুরুরা রে রে করে ছুটে আসে। এরকম কোন ঘটনা আমরা ঘটতে দেখিনি। 

সেই সমাজ সংস্কারক লেখক এর মত আমি উন্নত মানের লেখক নই। তাই আর বললাম না। উনি নিশ্চয়ই নিজের কল্পনা শক্তি কাজে লাগিয়ে এই সব কথা লিখেছেন। তাহা না হলে, উনি কি করে জানলেন ওই একান্ত ঘরে কি কি হয়েছে। এগুলো আজকের চটি গল্পের বইয়ের মতো গল্প। রাজনৈতিক মন্যতায় একে উপন্যাসের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

হুতোম প্যাঁচার নকশা কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক সামাজিক নকশা জাতীয় রচনা। বিছিন্ন বা কাল্পনিক কনো সামাজিক ঘটনাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক আকারে লেখা। এই হুতোম প্যাঁচার নকশা বইটিতে কোন শাস্ত্রিয় প্রমাণ নয়। তাই এর বক্তব্য উপেক্ষা করেই চলতে হবে। 


গুরু কে?

শ্রীশ্রীগুরুগীতা আনুশারে গুরু শব্দের অর্থ নিম্ন প্রকার বলা হয়েছে :-

গুকারশ্চান্ধকারঃ স্যাদ্ রুকারন্তন্নিরোধকঃ।
 অন্ধকারনিরোধিত্বাৎ গুরুরিত্যভিধীয়তে ।। (শ্রীশ্রীগুরুগীতা )

তারক উপনিষদের মতে, গুরু শব্দের অর্থ হচ্ছে গু=গুহা বা অন্ধকার, রু=তেজ বা আলো। পরম পুরুষ শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব একদা বলেছেন, "গুরু হলেন 'ঘটক’। যিনি ভগবানের সঙ্গে ভক্তের মিলন ঘটান। শিষ্যের মনের আকুলতা অনুযায়ী মন্ত্র ও ইষ্ট ঠিক করে দেন।"

শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, "যিনি তার আশ্রিত জনকে জন্ম-মৃত্যুর সংসার আবর্ত থেকে উদ্ধার করতে না পারেন, তার গুরু হওয়া উচিত নয়" (ভাঃ৫/৫/১৮)।  শ্রীগুরুই জ্ঞানালোক দ্বারা শিষ্যের অন্ধকারাচ্ছন্ন মনকে আলোকিত করেন। সকল শিষ্যের কাছে তাঁর নিজ গুরু সাক্ষাৎ পরমব্রহ্ম। তিনিই শিষ্যের ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর। তবে কোনও শিষ্যের উচিত নয় তাঁর গুরুকে ভগবানের প্রতিনিধি ভেবে অন্য গুরুর অবমাননা করা। বরং অন্যের গুরুদেবকে ভক্তি প্রদর্শন করাও প্রকৃত সদগুরুর প্রকৃত শিষ্যের পবিত্র কর্তব্য। 


প্রসাদ কাকে বলে?

প্রসাদ শব্দটি দুটি পদ 'প্র' 'সাদ' এর সমন্বয়ে গঠিত। পদ 'প্র' এর অর্থ পূর্বে, সামনে এবং 'সাদ' পদের অর্থ 'বাস করা'। প্রসাদ ক্রিয়াপদ ‘প্রসিদতি’   হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং যার অর্থ বাস করে, সভাপতিত্ব করে, খুশি করে বা অনুগ্রহ করে। যে কোন খাদ্য বস্তু  দেবতার প্রতিমূর্তির জন্য দেওয়া হয়, তা প্রসাদ বলে বিবেচিত হয়। 

বস্তুগত অর্থে, প্রসাদ একজন  ভক্ত ও দেবতার মধ্যে আদান প্রদানের একটি প্রক্রিয়া।উদাহরণস্বরূপ, একজন ভক্ত কোনো বস্তু যেমন ফুল, ফল বা মিষ্টির নৈবেদ্য দেয়। দেবতা তখন তাঁর সূক্ষ্ম অংশ ভোগ করেন। এই-ঐশ্বরিকভাবে বিনিয়োগ করা পদার্থকে ভোগ বলা হয় এবং ভক্ত দ্বারা গ্রহণ, পরিধান ইত্যাদি গ্রহণ করা পদার্থকে প্রসাদ বলা হয়।

ভোগের বস্তুকে ইষ্ট দেবতার চরণে নিবেদিত করে সেটা প্রসাদ বা প্রসন্ন রূপে গ্রহণ করা হয়। 

ভোগ নিবেদন পদ্ধতি (সংক্ষিপ্ত ):

ভোগ নিবেদন পাত্রে একটি করে তুলসী, বা বেল পাতা (দেব-দেবী ভেদে বেল বা তুলসি পাতা বর্জনীয় ) পাতা দিতে হবে। ভোগ নিবেদন পাত্রের পাশে একটি জলের পাত্র রাখতে হবে। ভোগ নিবেদনে আপনার গুরু প্রদত্ত দীক্ষামন্ত্র/পঞ্চতত্ত্ব/হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কমপক্ষে ১০ বার (প্রতি পাত্রের জন্য) জপ করে নিচের এই মন্ত্র উচ্চারণ করে ফুল, জল অর্পণ করুন।

নিবেদনের প্রণাম মন্ত্র :   

সমানায় স্বাহা
উপানায় স্বাহা
অপানায় স্বাহা
ব্যানানায় স্বাহা
পস্তুরমসি  স্বাহা
ভূ পতয়ে নমঃ
ভূব পতয়ে নমঃ
স্ব পতয়ে নমঃ
ভূভূর্বস্ব পতয়ে নমঃ
নারায়ণ শ্রীবিষ্ণবে নমঃ।
এতৎ সোপকরণামান্ননৈবেদ্যং
 ওঁ শ্রীশ্রীদেব বা শ্রীশ্রীদেব্যৈ নমঃ 

(বলে নৈবেদ্যে ফুল দিতে হবে)।

ভোগ নিবেদনের পর : বিগ্রহে বা ঘটে বীজমন্ত্রে ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী ধ্যান করতে হবে (কমপক্ষে ১০ বার) এই ভাবেই হিন্দু ধর্মশাস্ত্র প্রসাদ ও গুরুর ব্যাখ্যা করেছে। 

মনে হয় না, কোনো কালেও গুরুপ্রসাদি বলে কিছু ছিলো। এই সব কিছুই বিধর্মীদের কুমতলব ও কু -চক্রান্ত। অন্যের বউকে মা বলে স্মরণ করতে হবে, এটাই শাস্ত্রীয় বিধান আমরা জেনে এসেছি।

উপসংহার 

একটি সামাজিক ব্যঙ্গধর্মী রচনা কখনোই শাস্ত্রীয় বা ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসেবে গণ্য হতে পারে না।সমাজের যদি এমন কোনো গুরুপ্রসাদী প্রথা স্বীকৃত থাকত, তবে হিন্দু সমাজে এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা যেত।

কালীপ্রসন্নের মতো লেখকদের অনেক রচনা সমাজের দুর্বলতা ও কুসংস্কার তুলে ধরলেও, তা চরম অতিরঞ্জিত ছিল কি না সেটি বিচার্য। শাস্ত্র ও ঐতিহাসিক প্রমাণ ছাড়া এমন কাহিনি ভিত্তিহীন।

 আমার মতে, শুধুমাত্র ব্যঙ্গাত্মক রচনার ভিত্তিতে সমাজের মূলধারাকে বিচার করা উচিত নয়। এ বিষয়ে আপনার কি মতামত?

H. R. Sarkar is a dedicated blogger and entrepreneur with expertise in creating digital products and Blogger templates. Managing websites like TechaDigi.com and Hinduhum.net, they bring creativity and technical proficiency to their projects. Through their YouTube channel, Lost Eternal Science, H. R. Sarkar explores the fusion of Hindu spirituality and science, offering unique insights to their audience. With a passion for innovation, they strive to inspire and educate through their work.

0 Comments:

Smart Ads for Smart Businesses Ads by TDads