Headlines
Loading...
 ধর্ম কি? বৈদিক ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মমত গুলর মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

ধর্ম কি? বৈদিক ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মমত গুলর মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

ধর্ম শব্দটি হিন্দুদের সংস্কৃত শব্দ। একে রিলিজিয়ন বা দ্বীন বা মাযহাব বা সম্প্রদায়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে হবে না। কারণ, শব্দের সঠিক ব্যবহার অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অর্থ পরিবর্তন হলে সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়ে যায়। ইংরেজি ভাষার রিলিজিয়ন আর আমাদের ধর্ম এই দুটো শব্দ এক অর্থ কি বহন করে না। শব্দ নিয়ে  যে ভ্রান্তি আছে, সেটা বুঝে তবেই তার ব্যাবহার করা দরকার।

তাই, রিলিজিয়ন ও ধর্মের নামে যে যে সকল ভ্রান্তি আছে সেগুলো দূর করা দরকার। যেগুলো ধর্ম নয়, সেগুলোকে ধর্ম থেকে আলাদা করেই জানতে হবে। 

আমি যখন নিজেকে হিন্দু বলি, আমি নিজেকে সেই মাতৃ ভূমির সন্তান বলে গণ্য করি, যেই মাটিতে রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, মহাবীর, নানক জন্ম নিয়েছেন।

 আমি যখন নিজেকে সনাতনী হিন্দু বলি, আমি নিজেকে সেই সংস্কৃতির অংশ হিসেবে গণ্য করি যে সংস্কৃতিতে বুদ্ধ, মহাবীর, নানক নিজ নিজ মত প্রকাশ করে অক্ষত ছিলো। শুধু তাই নয়, তাঁরা নিজ নিজ মত প্রচারের জন্য কাউকে আঘাত পর্যন্ত করেনি। 

আমি যখন নিজেকে সনাতন বৈদিক হিন্দু বলি, তখন আমি নিজেকে সেই ধর্ম সাংস্কৃতির অংশ হিসেবে গণ্য করি, যেখানে বেদকে প্রমাণ মনে করে সকল শাস্ত্র গুলো ধারণ ও পালন করা হয়।

আজকের আলোচনার বিষয় বস্তুগুলো নিম্নরূপ : 


ধর্মের বিভিন্ন সংজ্ঞা :

সংস্কৃত ব্যাকরণে এবং বিভিন্ন হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে এই ‘ধর্ম’ শব্দটি বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আরবী, ফার্সী, ইঙ্গো প্রভৃতি পাশ্চাত্য দুনিয়ার কাছে ধর্ম ধর্মের তুল্য কোনো শব্দ ছিলো না।তাই Religion বা মাযহাবকে তারা ধর্মের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছে।

তাদের কাছে Religion হলো ইশ্বরের সৃষ্ট নিয়ম বা আদেশ। আমরা দেখেছি এই রিলিজিয়ান বা মাযহাব গুলো একটি কিতাব, একটি নবি (বা ভবিষ্যত বক্তা) ও একটি নির্দিষ্ট ঈশ্বর সত্তার আরাধনা করেন। সেই ইশ্বর ও পুস্তক ছাড়া অন্য কিছুই তারা সত্য বলে মনে করে না।

অপর দিকে সনাতন বৈদিক হিন্দু ধর্ম অনুসারে, ঈশ্বর কোনো একজন ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইহা ইশ্বর উহা ঈশ্বরের বিরোধী, এই ধরণের কথা সনাতন বৈদিক হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র গুলো বলে না।

প্রতিটি মানুষের মধ্যে, জড় পদার্থের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে এমন ধারণা আমরা স্বীকার করি। যে যে প্রকারে, যে ভাবেই, যে অবস্থায় তাঁর আরাধনা করুক না কেন। সেই এক এবং অভিন্ন ঈশ্বর সেই রূপে, সেই ভাবে, সেই অবস্থায় তাঁর ভক্তর আরাধনা স্বীকার করেন।

আদর্শ মানবতার ধর্ম হিন্দু ধর্ম :

My way is the high way — এই জিনিসটা সনাতন ধর্মে নেই। অর্থাৎ, "আমার ঈশ্বর একমাত্র সত্য, তোমার ঈশ্বর কাল্পনিক" এরকম আমাদের ধর্ম  বলে না।  

গীতায় ভগবান বলছেন, "যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্ মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।

গীতা শ্লোক ৪/১১ এর উপর শংকরাচার্য ভাষ্য হল:

ভাষ্যঃ ‘যে যথা’ যেন প্রকারেণ যেন প্রয়োজনেন যৎ ফলার্থিতয়া ‘মাং প্রপদ্যন্তে, তান তথা এব’ তৎ ফলদানেন ‘ভজামি’ অনুগৃহ্নামি ‘অহম’ ইতি এতৎ। তেষাং মোক্ষং প্রতি অনর্থিত্বাৎ।। ১১/১

অনুবাদঃ "যারা যেভাবে আমার ভজনা করে আমি তাকে সেই ভাবেই তুষ্ট করি। হে পার্থ, মনুষ্যগণ সর্বভাবের মধ্য দিয়ে আমার পথই অনুসরণ করছে।"

যারা সনাতন হিন্দুদের ঈশ্বর মানে না, তাঁদের যুক্তি ও সিদ্ধান্তকেও সনাতন বৈদিক হিন্দুরা সন্মান করে। কারণ, কোনো না কোনো ভাবে ঈশ্বরের অনুপ্রেরণায় এই বিরোধীরা মানুষের ভ্রান্তির নিরসন করে। যদি বিরোধী বা বিপক্ষকে প্রশ্ন তুলতে না দেওয়া হয়, তবে এই ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি স্থির জলাশয়ের মতো দুর্গন্ধময় হয়ে যাবে। সনাতন সত্যকে গ্রহন করে সময়ের সঙ্গে চলার কথা বলে।

পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাসে আমরা দেখেছি, ঈশ্বরই পুত্র, ঈশ্বরের দূত, সকলকে নিজের মত প্রচারের জন্য এসেছিলেন কিন্তু তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। কারণ, সেই দেশে পক্ষ-বিপক্ষ পরস্পর পরস্পরকে শয়তানের উপাসক মনে করে। এই ভ্রান্তির কারনেই ধর্ম আর Religion এক নয়।

তাই, ধর্ম নামে যে রিলিজিয়ন গুলো যে আজ প্রচারিত হয়েছে সেই সব কিছুই মানবিকতা বা অধর্ম বললেও ভুল হবে না।

সনাতন হিন্দু ধর্মতেও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু সনাতন হিন্দুদের নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাস ও নিজেকে এবং ধর্মের ভ্রান্ত মতবাদ পরিষ্কৃত, সংস্কৃত করার সুযোগ আছে। তাই ইহাকে আমরা একমাত্র আদর্শ মানব ধর্ম বলতে পারি।

তাই, ধর্ম শব্দের পরিভাষা হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র ছাড়া তথাকথিত অন্য কোনো ধর্ম গ্রন্থ গুলোতে নেই। হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে ধর্মের পরিভাষা নিম্নরূপ। 

যদি প্রশ্ন করা হয় একজন মানুষের ধর্ম কি? কি ভাবে ধার্মিক মানুষ আর অধার্মিক মানুষের নির্ণয় করা সম্ভব। তার জন্য এই শ্লোক বলা হয়েছে:  

ধ্রিয়তে ধর্ম ইত্যা হু স এব পরমং প্রভু 

'ধ্রিয়তে ধর্ম ইত্যাহু' মানে, 'ধর্ম সেই জিনিস যা বিশ্বকে ধারণ করে' অর্থাৎ ধর্ম হল সেই সমস্ত জিনিসের নাম যা সমগ্র সমাজে স্থিতিশীলতা ও শান্তি আনয়ন করে এবং তা বজায় রাখে। সেই (ধর্ম ) হলেন পরম প্রভু। ভালো,মন্দ যে যা ধারণ করে তাই ধর্ম।  

'ধরতি লোকম ধ্রিয়তে পুণ্যতমবিঃ ইতি ধর্ম'

অর্থাৎ,  'ধর্ম হল সেই উপাদান যা জগতকে ধারণ করে বা ধার্মিক আত্মাদের দ্বারা ধারণ করা হয়' এর সাথে পূজা-পাঠ, আচার-বিচার, মত-পথ, জাতি-সম্প্রদায়ের কোনো সম্পর্ক নেই। এই বিশ্বে যা কিছুই আছি আছে সব কিছুই ধর্ম দ্বারা ধৃত, রক্ষিত, ও পরিচালিত।  পদার্থের মধ্যে ধর্ম প্রকৃতিস্থ ভাবেই আছে।  মানুষের মধ্যে একে জানার উপায় আছে। স্মৃতি শাস্ত্র বলছে :

ধৃতিঃ ক্ষমা দম অস্তেয় শৌচং ইন্দ্রনিগৃহ।
ধীঃ বিদ্যা সত্যম্ অক্রোধ দশকম ধর্মস্য লক্ষণম্।।
 — (মনুস্মৃতি ৬ষ্ঠ অং ৯২ শ্লোক)

অর্থ: ধৃতি, ক্ষমা, দম, অস্তেয়, শৌচ, ইন্দ্রিয় নিগ্রহ, ধী, বিদ্যা, সত্য, অক্রোধ- এই দশটি ধর্ম্মের লক্ষণ। 

ধৃতি মানে দৃঢ়তা, দম অর্থাৎ কোন প্রকার চিত্তবিকৃতি হলে, যে শক্তি দ্বারা ঐ প্রবৃত্তির নিরোধ করা যায়। অস্তেয় অর্থাৎ অন্যের বস্তুর নিজের অধিকার না করা, শৌচ অর্থাৎ স্বচ্ছতা, ইন্দ্রীয় নিগ্রহ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের ওপর শাসন করার ক্ষমতা। ধী শব্দের অর্থ হলো বুদ্ধি, বা চিন্তা করার ক্ষমতা। বিদ্যা, সত্য, অক্রোধ  এই দশটি গুণ ধারন করেই একজন মানুষ ধার্মিক বলে পরিচিত হতে পারে। 

পূজা, অর্চনা, ব্রত, নিয়ম এগুলো ধর্মের অংশ বটে কিন্তু ধর্ম নয়। আজকাল মানুষ এগুলোকেই ধর্ম বলে মনে করে। 

আমরা রামায়নে দেখেছি-  শ্রী রাম পিতার আদেশে সিংহাসন ত্যাগ করে বনবাসে গিয়েছে। তিনি পুত্রধর্ম পালন করে ছিলেন। রাজা হওয়ার পর তার রাজ্যে সবাই সুখে ছিলো। সেটা ছিল তাঁর রাজধর্ম। প্রজা বৎসল রাম প্রজাকে শাস্তি না দিয়ে নিজের স্ত্রীর থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন, তাই তিনি পূজনীয়। তাই মানুষের চোখে তিনি ভগবান। 

আবার মহাভারতে - শ্রী কৃষ্ণ যখন অর্জুনকে বলছে, "স্বধর্ম নিধনং শ্রেয়, পর ধর্ম ভয়াবহ" তিনি কি অর্জুনকে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খৃষ্টান  বা মুসলিম ধর্ম ধারণ না করার কথা বলেছেন ? না তিনি সেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে একজন যোদ্ধার ধর্ম উপদেশ দিচ্ছেন। অতএব, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কর্ত্তব্য কর্মই ধর্ম

তাই Religion গুলোকে ধর্ম বলা যাবে না। সেগুলো Commandments বা আদেশ রূপে ব্যবহার করা হয়েছে। বিধি ও নিষেধ এগুলো আজ্ঞা।  তাই , খৃস্টান পন্থ আজ্ঞা বা ইসলাম পন্থ আজ্ঞা এইভাবে জানতে হবে। একবার দেখুন 

নির্জীব পদার্থের ধর্ম

মানুষ ছাড়া নির্জীব পদার্থের ধর্ম নিয়েও হিন্দু ধর্ম শাস্ত্র উল্লেখ্য করেছে। বৈশেষিক শাস্ত্রের রচয়িতা ঋষি কনাদ পদার্থের অস্তিত্ব সম্পর্ক লিখেছেন:
যতোঃভ্যুদয় নিঃশ্রেয়স সিদ্ধিঃ স ধর্মঃ।
— বৈশেষিক দর্শন, ১ম অধ্যায়, ১ম আহ্নিক, ২য় সূত্র

অর্থা:  যা জাগ্রত হলে নিঃশ্রেয়স সিদ্ধি হয় অর্থাৎ পরিপূর্ণতা লাভ করে, সেটাই ধর্ম।

রাজার রাজ ধর্ম:

মহাভারতে বেদব্যাস ভীষ্ম পিতামহের উক্তিকে উধৃত করে একজন রাজার ধর্ম কি হাওয়া উচিৎ সেটি বোঝাতে গিয়ে বলছেন:
ধারণাদ্ ধর্মম্ ইত্যাহু র্ধর্মেণ বিধৃতাঃ প্রজাঃ।
যঃ স্যাদ্ধারণসংযুক্তঃ স ধর্ম ইতি নিশ্চয়।।
—মহাভারত শান্তিপর্ব ১০৬.১৫

অর্থযাহা ধারন করা হয় তাহাই ধর্ম। ধর্মই প্রজার পালন করে(একত্রিত করে, বিচ্ছেদ দূর করে)। যা মানুষকে একত্রে আবদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে তা অবশ্যই ধর্ম।

অতএব, ধর্ম কোনো ইশ্বর, পরম শক্তিশালী কোনো দেবতার উপাসনা বা প্রার্থনায় সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মের প্রয়োজন আছে। তাই, আমি ধর্ম থেকে রিলিজিয়ন কে আলাদা করে দেখার মত প্রকাশ করছি। 

সংস্কৃত মাতৃকা বর্ণ ‘ধ+্ঋ’ » 'ধৃ' ধাতু ও 'মন' প্রত্যয় যোগে তৈরী হয়েছে “ধর্ম” শব্দটি। ধৃ অর্থাৎ, ধারন করা । ব্যাকরণ অনুযায়ী - যে কোনো শব্দের মূল রূপকে প্রকৃতি বলে। আবার ক্রিয়ার মৌলিক রূপকে ধাতু বলে। যেমন - ভূ, গম, ধৃ, কৃ ইত্যাদি। এই ধাতুর পড়ে বিশেষ বিশেষ নিয়মে যা যুক্ত হয় সেটিকে প্রত্যয় বলা হয়। উদাহরণ স্বরূপ, ভূ+তি=ভবতি, নর+সু=নরঃ, পান্ডু+ ষ্ণ= পাণ্ডব, রঘু+ষ্ণ=রাঘব ইত্যাদি। এখানে 'তি', ‘সু’, ‘ষ্ণ’ ও ‘মন’ হলো প্রত্যয় এবং ভূ, নর, পান্ডু, রঘু, ধৃ হলো ধাতু। ধর্ম কথার অর্থ রিলিজিয়ান বা দ্বীন বা মঝহবের তুল্য নয়।

Religion গুলো ধর্ম নয় কেন?

ইংরজীতে Religion শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Religare থেকে। যার অর্থ ছিলো ‘আবদ্ধ করা’ বা ‘নিয়ন্ত্রন করা’। Religare থেকে Religio যার অর্থ হলো বাধ্যবাধকতা, শ্রদ্ধা । সেই থেকে Religion শব্দ এসেছে।

সংজ্ঞা অনুযায়ীThe belief in and worship of a superhuman power or powers, especially a God or gods.

ধর্ম এমন কোনো জিনিস নয় যাহা মানুষকে বশ করে বা বল প্রয়োগ করে রীতি নীতি অন্ধ ভাবে অনুসরণ করেতে বাধ্য করে। আমরা ধর্ম -শব্দটি কোনো পদার্থের গুণ, তার প্রকৃতিক বা ভৌত অবস্থা উল্লেখ্য করতে ব্যবহার করে থাকি। যেমন, আগুনের ধর্ম হলো দহন করা, জলের ধর্ম হোলো উচু স্থান থেকে নীচু স্থানের দিকে বয়ে চলা ইত্যাদি। আবার সামাজিক কর্তব্য পালন বা নৈতিক জ্ঞান হিসেবেও ব্যবহার করি। যেমন, পুত্রের ধর্ম হলো তার মাতা পিতার সেবা করা, চাকরের ধর্ম হোলো প্রভুর সেবা করা। 

ইহুদী এবং খ্রিস্টানদের ১০টি  শপথ:

  • ১. তুমি আমায় ছাড়া আর কাউকে ঈশ্বর বলে মানবে না। 
  • ২. তোমার উপাসনার জন্য কোন খোদাই করা মূর্তি তৈরী করবে না।
  • ৩. তুমি তোমার ঈশ্বর  নাম অকারণে গ্রহণ করবে না
  • ৪. বিশ্রামবার স্মরণ রাখবে এবং এটি পবিত্র রাখবে।
  • ৫. তুমি নিজের বাবা এবং মাকে সম্মান করবে। 
  • ৬. তুমি হত্যা (কোনো মানুষকে) করবে না। - ঈশ্বর চান আমরা মানুষের জীবন রক্ষা করি।
  • ৭. ব্যভিচার করবে না। - এর অর্থ স্বামী এবং স্ত্রীদের একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত হওয়া উচিত
  • ৮. তুমি চুরি করবে না
  • ৯. তুমি মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে হবে না.
  • ১০. তুমি লোভ করবেন না

—উক্ত দশটি শর্ত ইহুদী এবং খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায় মেনে চলে। প্রথম পাঁচটি ছাড়া, বাকি পাঁচটি আমাদের হিন্দু ধর্মের সাধারণ ধর্মের লক্ষণের মতো একই কথা বলে। অহিংস, অবৈধ সম্পর্ক বা ইন্দ্রীয় নিগ্রহ, অচৌর্য, অসত্য সাক্ষী বর্জন, অপরিগ্রহ। 

এই গুলোই তাঁদের ধর্মে বজায় থাকার অঙ্গীকার। যারা এই দশ গুণের খেলাফ করে, বা ঠিক ঠিক পালন করে না, তারা স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে না। আমাদের সনাতন বৈদিক হিন্দু ধর্মে তেমন কোনো আদেশ নেই, কারণ স্বর্গধাম আমাদের শেষ গন্তব্য নয়।  আমাদের গন্তব্য মুক্তি।

একবার ভেবে দেখুন, যখন বলা হচ্ছে, " তুমি আমায় ছাড়া আর কাউকে ঈশ্বর বলে মানবে না। " তারমানে সেই ঈশ্বর ছাড়াও আরও ঈশ্বর আছে। 

উদাহরণ, "আমার দোকান ছাড়া অন্য দোকানের চাল কিনবে না।" আর "আমার দোকান ছাড়া অন্য দোকানের চাল কেনা সম্ভব নয়।" এই দুটি কথার অর্থ এক নয়। অন্য দোকানের চাল কেনা সম্ভব নয় কারণ অন্য কোনো দোকান নেই। 

ইসলাম দ্বীন:

ইসলাম মজহব একই কথা বলে। এই ইসলামের ধর্ম গ্রন্থ কোরআন শরীফেও এই একই আদেশ। "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু" অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। তাদের দৃষ্টিতে সেই আদেশের প্রতি যে যতো কট্টর সে ততই উন্নত। 

ইসলামের পাঁচটি কর্ত্তব্য আছে এই পাঁচটি কর্ত্তব্য হল ইসলামের মূল বিশ্বাস ও অনুশীলন:

  • শাহাদাহ (সাক্ষ্য দেয়া): বিশ্বাসের সাক্ষ্য দেয়া, যেখানে বলা হয়েছে "আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল"। এই শাহাদাহ পাঠ করে ইসলামে প্রবেশ করে। এরপর 
  •  সালাত: নামাজ।
  •  যাকাত: ধর্মীয় অর্থ দান।
  •  সাওম: রোজা রাখা বা একটি নির্দিষ্ট সময় উপবাস করা
  •  হজ: মক্কা মদীনায় তীর্থযাত্রা।

এগুলোই তাঁদের পরম কর্তব্য। হিন্দুদের উক্ত ধর্মের দশটি লক্ষণ এবং ইহুদী খ্রিষ্টানদের দশটি আদেশের অনুরূপ কোরআন বলেছে:

  • এসো, আমি তিলাওয়াত করব যা আল্লাহ তৈরি করেছেন আপনার জন্য একটি পবিত্র দায়িত্ব। বলো: ঈশ্বরের সমতুল্য কেউ নেই।
  • আপনি আপনার সন্তানদের প্রয়োজনের জন্য হত্যা করবেন না;  আমরা আপনার জন্য এবং তাদের জন্য রিজিক প্রদান.
  • প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক অশ্লীল আচরণের কাছে যাবে না।
  • তোমরা ন্যায় ও আইনের পথ ছাড়া করো জীবনকে হরণ করবে না, যাকে ঈশ্বর পবিত্র করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করেছেন, যাতে তোমরা প্রজ্ঞা শিখতে পার।
  • আর তুমি অনাথের উন্নতি করা ব্যতীত তার সম্পদের কাছেও যাবে না,  যতক্ষণ না সে পরিণত বয়সে পৌঁছায়।
  • ন্যায়বিচারে পরিমাপ ও ওজন সম্পূর্ণ কর। কোন আত্মার উপর কোন ভার চাপানো উচিত নয় কিন্তু তা বহন করতে পারে।
  • এবং যদি তুমি কথা রাখো, তাহলে তাহা পূর্ন করো, এমনকি যদি কোন নিকটাত্মীয় উদ্বিগ্ন হয় এবং ঈশ্বরের সামনে আপনার বাধ্যবাধকতা পূরণ করো। এভাবেই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন, যাতে তোমরা স্মরণ করতে পার।

দেখুন এই সব কিছুই অঙ্গীকার বা শর্ত, এগুলো আমাদের হিন্দু ধর্মের মতো নয়। অঙ্গীকার বা শর্ত দ্বারা  বদ্ধ হয়ে তারা চালিত হয়, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে কর্ত্তব্য অকর্তব্য বোঝে না। ঈশ্বরের প্রতি তাদের প্রবল বিশ্বাস। 

ধর্মের প্রতি নাস্তিক ও বামপন্থীদের ধারনা:

নাস্তিক ও বামপন্থিদের মতে ধর্ম হলো আচার, অনুষ্ঠান ও মানুষের কল্পনিক ইশ্বরের প্রতি একটি অন্ধবিশ্বাস ও কল্পিত ধারনা। যা মুলত Religion গুলোর সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়।।

তারা বলেন, (১) মানুষ যখন অসভ্য ছিলো, প্রকৃতিক দুর্যোগে ভয় পেতো, তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা তাদের থেকেও শক্তিশালী কোনো দেবতাকে স্মরণ করতো। সেই থেকেই ধর্মের উৎপত্তি। তাদের দৃষ্টিতে —ধর্ম মানুষকে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দেয়। (২) ধর্মের অনুসারীরা একজন পূজারী, মৌলবী বা পাদ্রীর অজ্ঞা পালন করে; রাজা, সুলতান বা কিং এঁদের রক্ষা করে, রাজ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তাদের মানসিক দাস করে রাখে। আবার আরেক ভাবে বলতে শোনা যায়, (৩) ধর্ম এক প্রকার আফিমের নেশার মতো। 

১৯৭০ সালের অ্যানেট ইওলিন এবং জোসেফ ওম্যালি নামক দুই চিন্তা বিদরালিক্ত5 খছেন:

Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people.

 অর্থাৎ —“রিলিজিয়ন হচ্ছে নির্যাতিত জীবের দীর্ঘশ্বাস , হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন অবস্থার আত্মা। রিলিজিয়ন হচ্ছে জনগণের আফিম।” 

তাঁর মতে; "মানুষই ধর্ম তৈরি করে, ধর্ম মানুষকে তৈরি করতে পারে না। যে খিদা তারা এই জগতে মেটাতে পারে না সেই খিদা মিটাতে ঈশ্বরের আশ্রয়। মানুষ এখনও নিজেকে খুঁজে পাননি কিংবা ইতিমধ্যে আবার নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন, ধর্ম হল সেই মানুষের আত্মচেতনা এবং আত্মসম্মান।" — অর্থাৎ মানুষ নিজের ধর্ম নিজেই তৈরী করে। নিজের অক্ষমতা, ব্যর্থতা, দূর্বলতা ঢাকতে মানুষ ধর্মের স্মরনাপন্ন হয়। তারা আরো বলেছেন। "মানুষ তো জগতের বাইরে তাঁবু খাটিয়ে থাকা কোনও বিমূর্ত সত্তা নয়। মানুষই জগৎ, রাষ্ট্র, ও সমাজ। এই রাষ্ট্র, এই সমাজ তৈরি করে, একটা উলটো জগৎচেতনা কেননা সেগুলো হচ্ছে এক উলটো জগৎ। ধর্ম হচ্ছে সেই উলটো জগতের এক সামগ্রিক তত্ত্ব।"


ব্যাকরণগত আপত্তি :

অ্যানেট ইওলিন এবং জোসেফ ওম্যালি যা কিছুই বলেছেন সেটা নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কারণ তাঁরা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির Religion কে দেখেছে। তাঁদের কাছে Religion হলো নির্যাতিত জীবের দীর্ঘশ্বাস , হৃদয়হীন জগতের হৃদয় এবং আত্মাহীনের আত্মা।

যারা ওই রিলিজিয়ান কে ধর্ম অনুবাদ করেছেন তারা এই গোলমাল করেছেন, সেই অনুবাদকদের উক্তি ও যুক্তি নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে। কারণ রিলিজিয়ান ও ধর্ম শব্দটি ব্যুৎপত্তিগত ও ব্যাকরণগত দিক থেকে একেবারেই আলাদা। মা যেভাবে কখনো মাসী হতে পারে না। সেভাবেই ধর্ম কখনো রিলিজিয়ান হতে পারে না। 

ইংরজীতে Religion ব্যাকরণগত ব্যাখ্যা ও ব্যুৎপত্তি বিশ্লেষণ :

পিতার সেবা করা পুত্রের রিলিজিয়ান বলা হয় না, ডিউটি বলা হয়। ইংরেজি ভাষায় বলা হয় না "আগুনের রিলিজিয়ন হলো দহন করা"। তাই, সাধারণ জ্ঞানেই রিলিজিয়ান ধর্ম এক বস্তু হয় নয়। এই ভাবেই sacrament কে বলা হয় সংস্কার। ল্যাটিন মূল শব্দ (root word) ‘sacer’ বা Sacred বা পবিত্র -ment suffix (প্রত্যয়) যোগে তৈরী হয়েছে sacrament. ল্যাটিন অনেক শব্দই সংস্কৃতের মতো শোনায়। যেমন: Septa ≈ সপ্ত , Octa≈ অষ্ট , Nevam≈ নবম  Deca ≈ দশম  সেরকমই sacer স্যাকর আর সংস্কার একই রকম শোনায়। এবং আশ্চর্য ভাবে এঁদের অর্থ গুলোও একই। কিন্তু যখনই বলা হয় কুসংস্কার তখন এটাই superstition হয়ে যায়।  এই superstition এর ব্যুৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ stare যার অর্থ "to stand" । superstare বা কট্টরতা। 

তবেই দেখুন কিভাবে শব্দের ভুল অর্থ আমাদের মূখে মুখে ঘুরছে। একেই বলা হয়  power of Narrative . তাই আমাদের শব্দ প্রয়োগ নিয়ে সতর্ক হওয়া উচিৎ। 

যদি বলা হয় — 'চোরের ধর্ম চুরি করা' তবে কি চুরি করা কি ধর্ম হয়ে যায়?

জগতের সকল বস্তুই ধর্মের অন্তর্গত কিন্তু মানুষকে ধর্ম জ্ঞান অর্জন করতে হয়। এই জন্যে যাহা ধর্ম নয় তা'কে অধর্ম বলা হয়। অধর্মের মধ্যেও ধর্ম শব্দটি আছে, কিন্তু সেটা বিপরীত অর্থ বহন করে। যেমন যাকে আমরা অমানুষ বলি সেও তো একজন মানুষই। সেভাবেই চুরি করা অধর্ম। ধর্ম তো বটে, কিন্তু সেটা বিপরীত অর্থে। 

চোরের ধর্ম যদি চুরি করা হয় তবে সেটা কেবমাত্র চোরেরই ধর্ম হবে। যে ব্যক্তি চোর, কেবল সেই চুরি করে। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সেটা গ্রহন যোগ্য হবে না। ধর্ম জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তির কাছে চুরি করা ‘অধর্ম’ বলে গণ্য হবে।

উপসংহার 

পরমাণু, জীবাণু, কীট, পতঙ্গ, ছাগল, কুকুর, সাপ, ব্যাঙ, ডাকাত, চোর, সাধু, পাগল, দেবতা, সকলের নিজ নিজ ধর্ম অনুসারে নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই, ধর্মকে কেউ সৃষ্টি করতে পারে না। ধর্মকে যথা রূপে নির্ণয় করে তার পালন করতে হয়। তাই ‘ধর্ম’-এই শব্দের অর্থ নিয়ে কোনো সন্দেহর অবকাশ থাকলো না। 

ধর্ম কি? বৈদিক ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মমত গুলর মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
ধর্ম শব্দটি হিন্দুদের সংস্কৃত শব্দ। একে রিলিজিয়ন বা দ্বীন বা মাযহাব বা সম্প্রদায়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে হবে না। কারণ, শব্দের সঠিক ব্যবহার অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রিলিজিয়ন ও ধর্মের নামে যে যে সকল ভ্রান্তি আছে সেগুলো দূর করা দরকার। যেগুলো ধর্ম নয়, সেগুলোকে ধর্ম থেকে আলাদা করেই জানতে হবে।
full-width

H. R. Sarkar is a dedicated blogger and entrepreneur with expertise in creating digital products and Blogger templates. Managing websites like TechaDigi.com and Hinduhum.net, they bring creativity and technical proficiency to their projects. Through their YouTube channel, Lost Eternal Science, H. R. Sarkar explores the fusion of Hindu spirituality and science, offering unique insights to their audience. With a passion for innovation, they strive to inspire and educate through their work.

0 Comments: